২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাংলাদেশের জনগণের জন্য রাজস্ব আদায় এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য যে জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে তা সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন করা গেলে দেশ ও জাতির মঙ্গল সাধন সাঠিত হবে। বাজেটে দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা ও বৈশ্বিক মন্দার পাশাপাশি আগামী নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যেও কিভাবে জনগণের উন্নয়ন সাধন করা যায় সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আয় বৈষম্য হ্রাসকল্পে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ অপ্রত্যক্ষভাবে সেফটি নেট বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রহণ করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কেবল মার্কিন ডলারে না রেখে দেশের রিয়েল এফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেইটের বাস্কেটে যে সমস্ত মুদ্রাসমূহ রয়েছে সেগুলোর বিপরিতে লেনদেন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা বাঞ্চনীয়। যাতে করে একটি বাস্কেটে বর্তমান বৈশ্বিক মন্দার সময়ে মুদ্রা রাখার চেয়ে বিভিন্ন মুদ্রায় বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন করা গেলে তা দেশের জন্য নিরাপদ হবে।
এ বাজেটটি অবশ্যই আপামর জনসাধারণের জন্য সংস্কারমূলক এবং মেহনতী ও শ্রমজীবী মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন, আর্থিক অন্তর্ভূক্তির জন্য ইতিবাচক প্রভাব বয়ে আনবে। যদি সতত, ন্যায়-নিষ্ঠা এবং দুর্নীতিমুক্তভাবে বাস্তবায়ন করা যায়। জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী এ এইচ এম মোস্তফা কামাল আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ দশমিক ৬১ ট্রিলিয়ন বাংলাদেশ টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করেছেন।
নিত্যপণ্যের দামের উর্ধ্বগতি রোধকল্পে বাজেটে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অর্থমন্ত্রী বাজেটে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায্য ব্যবস্থপনার উপর গ্ররুত্ব দিয়েছে। দেশে টেকসই ও আন্তর্ভূক্তিমূলক অর্থব্যবস্থাপনার ওপর সরকার গুরুত্বারোপ করেছেন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হচ্ছে সেখানে জাতীয় বাজেট ‘সরকারপ্রধানের পেটে-ভাতে রাজনীতির অর্থনীতির তত্ত্ব’।
দেশে এমনিতেই ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ৯-এরও কম। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, ভারত থেকে বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত কম। এ দেশে জন্মগ্রহণকারী হিসাবে নূন্যতম আয়কর দুই হাজার টাকা জমা দেওয়ার যে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে তা অবশ্যই প্রসংসার যোগ্য।
বস্তুতঃ এদেশে পুজিবাজার তৈরি করা গেলে তা দেশের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনত। পুজিবাজারকে ক্ষুদ্র মাঝারী শিল্পে বিনিয়োগের হাতিয়ার করা গেলে বর্তমানে দেশের যে অগ্রযাত্রা তা আরও শানিত হতো। শিক্ষাখাতে মোট ৬ হাজার ৭১৩ মোটি টাকা বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে এক হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী দেশে একটি জনবান্ধব স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের অঙ্গিকার করেছেন। সমস্যা হলো চিকিৎসক সাহেবদের অধিকাংশই হাসপাতালের নামকাওয়াস্তে থাকতে পছন্দ করেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কাছে স্বাস্থ্য সেবা অনেক হাসপাতালে জিম্মি হয়ে পড়ে থাকে। আবার উচ্চ প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায় স্বল্প সংখ্যক শিক্ষক গবেষণা করেন। অন্যদিকে যারা লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়ার কথা তারা শিক্ষক কর্মচারিদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে ব্যস্ত থাকেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধিটা যুক্তিযুক্ত। দেশের সাধারণ মানুষ মানবিক পুলিশের সহায়তা পাক, এটি সর্বাগ্রে প্রয়োজন। কৃষিখাতে সরকার ৮৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। কৃষিখাত বর্তমান বৈশ্বিক মন্দার সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ বরাদ্দ তিনগুন বৃদ্ধি করলে ভালো হতো।
সরকার যেখানে সরবরাহজনিত সমস্যার সমাধানকল্পে ১০টি মেগা প্রজেক্ট গ্রহন করেছেন সেখানে কৃষক যেন ন্যায্য মূল্য পায় তার জন্য একটি উদ্ভাবনী কর্মপরিবেশ তৈরী করা বাঞ্চনীয়। একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ির জন্যে কার্বন কর ২৫ হাজার টাকা নিরুপন করা যৌক্তিক হয়েছে। রাস্তার তীব্র যানজট নিরসনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
প্রত্যাশা রয়েছে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হবে। আবার অর্থনীতিকে গতিশীল করার জন্য বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ উন্নীত করতে হবে। তবে বেসরকারি খাতকে অবশ্যই বিনিয়োগ ব্যাবস্থাপনায় এগিয়ে আসতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকির মাধ্যমে টিসিবির সহায়তায় খাদ্য বিক্রির ব্যাবস্থা রাখা হয়েছে। এটি অবশ্যই ইতিবাচক দিক।
অপচয় হ্রাসকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এটি বাস্তবায়ন করা দরকার। কেননা অপচয় কমানো গেলে দেশের মানুষের মধ্যে বন্টন ব্যবস্থায় সেই অর্থ বিতরণ করা যেতে পারে। বর্তমানে কৃচ্ছতাসাধনের বিকল্প নেই।
যে সমস্ত ব্যাবসায়ী পারমুটেশান ও কম্বিনেশান করে বিভিন্ন সময়ে বাজারে বিভিন্ন দ্রব্যের দাম বাড়াচ্ছে তাদের জন্য মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে বিল পাশ করা দরকার।
প্রস্তাবিত বাজেটে দারিদ্র হ্রাস, সমতাভিত্তিক সমতা সাধনে গৃহ নির্মান কর্মসজন ও পল্লী উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদান ও সামাজিক কর্মসূচির কথা বলা হয়েছে। ভবিষ্যতে আশা করব okun’s (ওকুনস) ল অনুসারে জিডিপি ২ শতাংশ দেয় সরাসরি করে ১ শতাংশ কর হ্রাস হবে।
ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের কথাও বলা হয়েছে। ক্যাশলেস সোসাইটি সাম্য ও ন্যায় ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরীর মাধ্যমে রাষ্ট্রসমাজ ও মানব ব্যবস্থাপনায় উত্তীর্ণ সাধনের কথা বলা হয়েছে। আসলে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার মানুষের কল্যাণ চান। বাজেটটি কল্যাণমুখী মানব প্রত্যয়ে ভরপুর। যারা বাজেট বাস্তবায়ন করেন এবং আপামর জনসাধারণকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে।
একটি কথা না বললেই নয়, বিবিএস যে পুরনো পদ্ধতিতে গিনি সহগ বের করে চলেছেন এর পেছনে কারোর কালো হাত কাজ করছে কিনা সেটা একমাত্র গোয়েন্দারা খুঁজে বের করতে পারে।
যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্ভাবনের জন্য দেশে বিদেশে সমাদৃত হোন সেটি অমূল্য মানব উন্নয়নের অন্তর্ভুক্তি স্বরূপ। আবার ডিজিটালাইজেশনে বাংলাদেশের প্রশংসনীয় উন্নতি হয়েছে।
ঘোষিত বাজেট আসলে মানব উন্নয়নের হাতিয়ার। পরিকল্পনা কমিশন বিভিন্ন সময়ে যাদেরকে দিয়ে কনসালটেন্সি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার জন্য করেছেন তাদের ভূমিকা এখন কী? কতটুকু তারা সরকারের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশংসা করেছেন সেটিও তদন্ত করে দেখা দরকার।
জনকল্যাণমুখী বাজেট বাস্তবায়ন করা গেলে ভালো হবে। যারা গিরগিটির মতো রঙ পাল্টাচ্ছে সাদা কে সাদা বলতে পারছে না প্রোপাগান্ডা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলুক।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাসংক্রান্ত বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, আইটি ও উদ্যোক্তা বিশেষজ্ঞ। সাবেক উপাচার্য প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।
Pipulbd@gmail.com