।। মৌলভী মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ভুইয়া শিবপুরী আল-চিশতী, আল-কাদরী, আল ওয়াইসী ।।
তরিকা শব্দটি আরবি তারিক শব্দ হইতে পরিগৃহিত হয়েছে, এর বাংলা অর্থ হলো পথ, রাস্তা ইত্যাদি। কিন্তু অবশ্যই বুঝতে হবে যে, এই পথ কোনো সাধারণ পথ নয় বরং মহান আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করার নিমিত্তে যে পথ অতিক্রম করা হয়ে থাকে মূলত সেই পথকেই তরিকা বলা হয়ে থাকে। ইসলামী আধ্যাত্মিক পরিভাষায় তরিকা হলো বেলায়েতের জ্ঞান অর্জন করতে আল্লাহর অলিগণের প্রবর্তিত বিভিন্ন সাধন পদ্ধতি, আর সে পথটির সিলসিলা বুঝতে হলে জানতে হবে যে, পবিত্র কোরআনের দিক নির্দেশনা এবং রাসুল (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বায়াতদের দিক-নির্দেশনার আনুগত্য করাই হচ্ছে মহান আল্লাহর নৈকট্য হাসিল অর্থাৎ পরিপূর্ণতায় পৌঁছানোর পথ। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘লাকাদ কানা লাকুম ফি রাসুলিল্লাহ্ উসওয়াতুন হাসানাহ…।’ অর্থাৎ আল্লাহর রাসুলের মধ্যেই রয়েছে তোমাদের জন্য সকল সুন্দরের আদর্শ।
যুগেযুগে আমাদের এই বঙ্গে আগমন ঘটেছে অসংখ্য পীর আউলিয়া, দরবেশ ও ছুফি সাধকের। যারা তাদের জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে মানবতার কল্যানে বিলিয়েছেন তাদের অমুল্য জ্ঞানের বাণী। বিনিতচিত্তে দেখিয়েছেন আলোর পথ। সাথে বাংলার লোকসংস্কৃতি তাদের পদচারনায় হয়েছে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর।
সূফীগং নিজেদের আধ্যাত্মিক সাধানার মাধ্যমে বিভিন্ন তরিকা বিভিন্ন ভাবে প্রচার করেছেন। এসকল তরিকার মাঝে মাদারিয়া তরিকা অন্যতম একটি তরিকা। কুতুব-ই-জাহান, হযরত সৈয়দ বদিউদ্দিন আহমেদ জিন্দা শাহ মাদার (৮৫৭ – ১৪৩৪) ছিলেন প্রখ্যাত আধ্যাতিক সুফি সাধক যিনি মাদারিয়া তরিকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি কুতুব-উল-মাদার নামেও পরিচিত।
তার জন্মস্থান আরবজাহানের পার্শবর্তী তৎকালিন শাম রাজ্যের (বর্তমানে সিরিয়া) হলব নামক স্থানে ২৪২ হিজরি সনে শাওয়াল মাসের ১ তারিখে সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ কুদওয়াতউদ্দীন আলী আল-হাল্বী ও তার মা ছিলেন সৈয়দা ফাতিমা সানিয়া। তার পিতা হযরত ইমাম হোসেন (আ.) এর বংশধর এবং তার মা হযরত ইমাম হাসান (আ.) এর বংশধর, সে হিসেবে তিনি আল-হাসানি-ওয়াল-হোসাইনি।
প্রখ্যাত সূফী সাধক হযরত বায়াজীদ তায়ফুর আল-বোস্তামি (রহ.) ছিলেন তার মুরশিদ, পীর বা আধ্যাত্মিক শিক্ষক। মদিনায় এক তীর্থযাত্রা শেষে তিনি ইসলামী মতবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারত গমন করেন। এখানে তিনি মাদারিয়া তরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তেরো শতকে আশরাফ জাহাঙ্গীর সেমনাণী সহ ভারতে আগমন করেন।
মাদারিয়া তরিকা উত্তর ভারত, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ, মেওয়াত অঞ্চল, বিহার, গুজরাত ও বাংলায় জনপ্রিয় এবং একইসাথে নেপালে ও বাংলাদেশেও জনপ্রিয় সুফি তরিকা। প্রচলিত প্রথা ভাঙা, বাহ্যিক ধর্মীয় অনুশীলনের উপর শিথীলতা এবং আত্ম যিকিরের উপর জোর প্রয়োগের করনে এই তরিকার পরিচতি ব্যাপক। এই তরিকার প্রতিষ্ঠাতা সুফি সাধক সৈয়দ বদিউদ্দীন জিন্দা শাহ মাদার (রহ.) উত্তরপ্রদেশের কানপুর জেলার মকানপুরে তার দরবার (দরগাহ ) প্রতিষ্ঠা করে এই অঞ্চলে তরিকা প্রচার করনে।
সুফিবাদের এই শাখা হজরত আলী (আ.) নিকট হইতে হজরত হাসান বসরী (রহ.) মারফত তাঁর শিষ্য খওয়াজা হাবিবে আজমী-এর সহিত সংযোগ সূত্র স্থাপন করে। খওয়াজা হাবিবে আজমীর নিকট হইতে তাঁর শিষ্য/মুরিদ হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) মারফত তৈয়ফুরিয়া প্রবর্তন হয়। তৈয়ফুরিয়া তরিকা থেকে শুরু করে, তাঁর পীর বা আধ্যাত্মিক শিক্ষক বায়াজীদ তায়ফুর আল-বোস্তামি কর্তৃক প্রবর্তিত তৈয়ফুরিয়া তরিকা থেকে উৎপত্তি হয়ে মাদারীয়া তরিকা ১৫ থেকে ১৭ শতকের মাঝামাঝি মুগল আমলে বিশেষ গৌরব অর্জন করেছিল এবং শাহ মাদারের শিষ্যদের মাধ্যমে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা, বাংলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এ নতুন তরিকা ছড়িয়ে পড়ে। বেশিরভাগ সুফি তরিকার মতই এটির প্রতিষ্ঠাতা মাদারের নামে একটি নিস্বাকে যুক্ত করে নির্মিত হয়েছে যা মাদারিয়া তরিকা নামে পরিচিত।
খেলাফত প্রদান
তরিকার প্রতিষ্ঠাতা সুফি সাধক সৈয়দ বদিউদ্দীন জিন্দা শাহ মাদার (রহ.) এর প্রায় সোয়া লক্ষ খলিফা ছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন : সদন শাহ সম্রাট, গুজরাটে মাজার। মজনু শাহ মাদারিয়া তরিকার সুফি সাধক এবং বাংলায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্যের বিরুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের নায়ক ছিলেন। আজমে মাদারিয়া ফকির শাহ অপূর্ব মীর চিশতী আল খিজিরী(শান্ত ফকির) যিনি মাদারি তরিকার ফকিরী ধারার তালিম একত্রিত করিয়া সুশৃঙ্খলভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন,তারাইল ভাংগা ফরিদপুর গঙ্গীমাদার দরগাহ শরিফ এ উনার আস্তানা
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শাহ মাদার এর সম্মানে তার নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা, সড়ক, গ্রাম, জেলা, অঞ্চলের নাম করন হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ- মাদারিপুর জেলা। জামালপুর জেলা, বাংলাদেশ- মাদারগঞ্জ উপজেলা। হাটহাজারী উপজেলা, চট্টগ্রাম জেলা, বাংলাদেশ – দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়ন, উত্তর মাদার্শা ইউনিয়ন। সাতকানিয়া উপজেলার, চট্টগ্রাম জেলা, বাংলাদেশ- মাদার্শা ইউনিয়ন। এসফাহন, ইরান – মাদ্রাসা-য়ে মাদার-ই-শাহ (শাহ মাদার ধর্মতত্বীয় মাহাবিদ্যালয়)। ঝিলাম জেলা, পাঞ্জাব, পাকিস্তান- মৌজা জিন্দা শাহমাদার, জিন্দা শাহমাদার সড়ক, সরকারি বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয় জিন্দা শাহ মাদার। সিরাহা জেলা, সগরমাথা অঞ্চল, নেপাল- মাদার গ্রাম উন্নয়ন সমিতি (নেপাল)। হাওড়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত- ঐতিহ্যবাহী মাদার শাহ বাবার মেলা। মাদার গান ইত্যাদি।
২৯ ডিসেম্বর ১৪৩৪ তিনি ইন্তেকাল করেন। ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুর শহরের কাছে মকানপুরে তার মাজার শরীফ অবস্থিত। এখানে প্রতি মাসে বিশেষ করে বার্ষিক ওরস উদযাপনের সময় হাজার হাজার দর্শনার্থী, ভক্তবৃন্দ পরিদর্শন করে।
মাদার গান বাংলার লোকসংস্কৃতির এক অমূল্য সৃষ্টি। মাদার গানের মূল উপজীব্য হল শাহ মাদার নামক পীরের গুণগান। মাদার অনুসারীদের ধারনা, মাদার পীর একজন মারেফতি পীর। কথিত আছে, বেহেস্ত থেকে হারুত-মারুত নামক দুজন ফেরেস্তা পৃথিবীতে এসে এক সুন্দরী নারীর প্রেমে পতিত হন ও তাদের প্রেমের ফলেই জন্ম হয় মাদার পীরের; তবে বাস্তবে এ কাহিনীর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি। গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা রোগ-শোক ও সকল প্রকার অমঙ্গল থেকে রক্ষা পাবার জন্য মাদার পীরের কাছে মাণ্যত করার জন্য যে অনুষ্ঠানের প্রচলন করে তা মাদার গান নামে পরিচিত হয়।
গবেষকরা মাদার পীরকে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিহিত করেন। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, মাদার পীরের প্রকৃত নাম বদিউদ্দিন শাহ মাদার। তার অনুসারীদের মাদারিয়া বলা হয়। অঞ্চলভেদে মাদার পীর ‘শাহ মাদার’ বা ‘দম মাদার’ নামে অভিহিত হন। এ গানের উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের নাটোর জেলার চলনবিল অঞ্চলে। এছাড়া দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নেত্রকোনাসহ আরও কয়েকটি অঞ্চলে এ গান ‘মাদারের বাঁশ তোলা’ বা ‘মাদার বাঁশের জারি’ নামে প্রচলিত।
মাদার গানের বেশ কয়েকটি পালাগান রয়েছে। এর মধ্যে মাদারের জন্ম খন্ড, কুলসুম বিবির পালা, মাদারের ওরসনামা, বড় পীরের পালা, জুমলের জন্মকাহিনী, হাশর-নাশর, খাকপত্তন পালা, মাদারের শেষ ফকিরি, বিবি গঞ্জরার পালা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অনুষ্ঠানের শুরুতে মাদার পীরের বন্দনার পর দর্শকদের কিংবা বায়োজোষ্ঠ্যদের ইচ্ছানুযায়ী যেকোন একটি পালা গাওয়া হয়, রাতভর চলতে থাকে অনুষ্ঠান।
[ লেখক: পরিচালক, বিশ্ব আশেকান মজলিশ পাক দরবার শরীফ, শিবপুর, নরসিংদী]