ফিরোজ মাহবুব কামালঃ
কোন দেশে সবচেয়ে ভয়ংকর বিপর্যয়টি মহামারি, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি বা সুনামীতে ঘটে না। এরূপ দুর্যোগের কারণে কোন দেশ বিশ্বজুড়ে কলংকিত বা অপমানিতও হয় না। কারণ, এমন বিপর্যয়ের জন্য দায়ী জনগণ নয়। বরং দেশবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয়টি ও সবচেয়ে বড় অপমানটি আসে রাষ্ট্র ও সমাজ চোর-ডাকাত, খুনি ও দুর্বৃত্তদের দখলে যাওয়ায়। তাদের শাসনে শুধু যে সামাজিক সুখশান্তি ও জানমালের নিরাপত্তা বিপন্ন হয় তা নয়, বরং সে দুঃশাসনে সবচেয়ে বড় বিপদটি ঘটে মৃত্যহীন পরকালে। কারণ তারা অসম্ভব বা দুরুহ করে জান্নাতে লক্ষ্যে সিরাতুল মুস্তাকীমে চলা। তারা কঠিন করে পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞান লাভ ও পূর্ণ ইসলাম পালন। তাছাড়া তারা বাড়ায় দুর্বৃত্ত শাসনের কাছে আত্মসমর্পণ ও সে শাসনের সাথে সহযোগিতা। এবং সে আত্মসমর্পণ ও সহযোগিতা অনিবার্য করে জাহান্নাম। সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে জাহান্নামের উম্মুক্ত পথ নির্মাণই হলো এমন দুর্বৃত্ত শাসনের মূল প্রকল্প। চোর-ডাকাতদের হামলায় কিছু লোকের অর্থহানি বা প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু রাষ্ট্রের বুকে চোর-ডাকাতদের শাসন জেঁকে বসলে তাতে শুধু জনগণের অর্থহানি বা প্রাণহানিই ঘটে না, ঈমানহানী এবং সে সাথে জাহান্নাম প্রাপ্তি ঘটে কোটি কোটি মানুষের। তাই দুর্বৃত্ত শাসকদের দু্র্বৃত্তির চেয়ে অধিকতর গুনাহর কাজ যেমন নেই, তেমনি তাদের নির্মূলের চেয়ে অধিক ছওয়াবের কাজও নেই।
রাষ্ট্র ও সমাজের বুক থেকে দুর্বৃত্ত-নির্মূলের কাজটি প্রতি দেশে এবং প্রতি যুগে অতি কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। এটি হলো রাষ্ট্রবিপ্লব ও সভ্যতা নির্মাণের কাজ। এতবড় বিশাল কাজটি কিছু বক্তৃতা-বিবৃতি, রাজপথের কিছু মিছিল, কিছুদিনের হরতাল, টিভি টকশো, পত্রিকায় কলাম লেখার মধ্য দিয়ে সাধিত হয় না। এমন বিপ্লবে প্রাণহানি ঘটে হাজার হাজার মানুষের। সামান্য চোর ধরতে হলেও চোরের পিছনে দৌড়াতে হয়। ডাকাত ধরতে হলে তো তার সাথে অস্ত্রহাতে যুদ্ধে নামতে হয়। সে কাজে প্রাণ যাওয়ার সম্ভাবনাও কি কম? বেতনের লোভে বা স্রেফ চাকুরি বাঁচাতে কেউ কি এমন কাজে প্রাণ দেয়? তাই নিছক বেতনভোগীদের হাতে কোন কালেই দুর্বৃত্ত-নির্মূল হয়নি। উচ্চতর সভ্যতাও নির্মিত হয়নি। বরং এক দল দুর্বৃত্তদের হটিয়ে তখন আরেক দল নতুন দুর্বৃত্ত ক্ষমতায় বসে। নির্মিত হয় নতুন সাম্রাজ্য, উপিনিবেশবাদের মত নতুন দুর্বৃত্তশাসন। তখন প্রচুর প্রাসাদ, অফিস-আদালত, দুর্গ, সামরিক ছাড়নি ও কল-কারখানা গড়ে উঠলেও উচ্চতর মানবিক মূল্যবোধ ও সভ্যতা নির্মিত হয় না ।
রাষ্ট্রের বুক থেকে চোর-ডাকাত ও দুর্বৃত্ত নির্মূল স্রেফ দোয়া-দরুদ বা ওয়াজ-নসিহতে হয় না। প্রয়োজন পড়ে লাগাতর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের। ইসলামে এমন যুদ্ধকে বলা হয় জিহাদ। এমন জিহাদে প্রয়োজন পড়ে হাজার হাজার মোজাহিদের। জিহাদ যেমন মহান আল্লাহতায়ালার আল্লাহর নিজস্ব বিধান, তেমনি সে জিহাদে মুজাহিদ সংগ্রহের দায়িত্বটিও খোদ মহান আল্লাহতায়ালার। লড়াকু সৈনিক সংগ্রহের সে কাজে মহান আল্লাহতায়ালা প্রতিটি ঈমানদারের সাথে এক চুক্তি সম্পদন করেন। সে চুক্তিনামাটি হলো মু’মিনদের থেকে তাদের জানমাল ক্রয়ের। বিনিময়ে তারা যুদ্ধ করে দুর্বৃত্ত নির্মূল ও ইসলাম প্রতিষ্ঠার জিহাদে।বিনিময়ে তারা পায় অনন্ত কালের জন্য নিয়ামতপূর্ণ জান্নাত। সে চুক্তিনামাটি এরূপঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন। বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। (শর্ত হলো) তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাস্তায়,তারা (শত্রু) নিধন করে এবং নিজেরাও নিহত হয়। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুর’আনে এ বিষয়ে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আর প্রতিশ্রুতি পালনে আল্লাহ অপেক্ষা আর কে বেশী সাচ্চা? তোমরা আল্লাহর সাথে যে চুক্তি করেছো তার জন্য আনন্দিত হও। ইহাই তো মহা সাফল্য।” –(সুরা তাওবা আয়াত ১১১)।উপরুক্ত আয়াতে যে বিষয়টি অতি সুস্পষ্ট তা হলো, যারাই মু’মিন তারাই আল্লাহর সাথে অবশ্যই চুক্তিবদ্ধ। ঈমানদার হওয়ার শর্ত তাই শুধু মহান আল্লাহতায়ার অস্তিত্বে ও তাঁর নবী-রাসূলে বিশ্বাসী হওয়া নয়। স্রেফ নামাযী,রোজাদার, হাজী বা যাকাত দানকারি হওয়াও নয়। বরং মহান আল্লাহতায়ালার কাছে নিজের জানমালের বিক্রয়ে চুক্তিবদ্ধ হওয়া। মহান আল্লাহতায়ালা তো এমন চুক্তিবদ্ধদেরই জান্নাত দানে চুক্তিবদ্ধ। এমন চুক্তিবদ্ধ মু’মিনদের জীবনে তখন শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত আসে না। পবিত্র জিহাদ এবং সে জিহাদে শাহাদতও আসে। নবীজী (সা:) র সাহাবাগণ তো সে চুক্তিবদ্ধ মু’মিনদের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তাদের কারণে জিহাদের ময়দান সেদিন মুজাহিদের দ্বারা পূর্ণ হয়ে উঠতো। নবীজী (সা:) র কি এমন কোন সাহাবা ছিলেন যিনি জিহাদের ময়দানে হাজির হননি? ফলে সমাজ থেকে নির্মূল হয়েছে দুর্বৃত্তশাসন ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে পরিপূর্ণ ইসলামী শাসন। মুসলিম সমাজে তাই জিহাদে সৈনিক পেতে কোন রিক্রটমেন্ট সেন্টারের প্রয়োজন পড়ে না। কোন বিজ্ঞাপনেরও প্রয়োজন পড়ে না। পবিত্র কুর’আন মুজাহিদ সংগ্রহের সেটি নীরবে করে।