স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ার মুহূর্তের বর্ণনা দিয়েছেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ। জাহাজের সেকেন্ড অফিসারের দিকে চারটি এবং ক্যাপ্টেনের দিকে দুটি একে-৪৭ অস্ত্র তাক করে জাহাজটিকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে তার বর্ণনায়।
মঙ্গলবার (১৪ মে) বিকেলে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) এক নম্বর জেটিতে পৌঁছানোর পর জলদস্যুদের হাতে জম্মি হওয়া জাহাজটির ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
এমভি আব্দুল্লাহর ক্যাপ্টেন বলছেন, জলদস্যুদের কবলে পড়ার সময় জাহাজ ছিল পণ্যবোঝাই। ফলে গতি ছিল কম, মাত্র ১০ মাইল। এ কারণেই সোমালিয়ান জলদস্যুদের নৌযান এড়ানো যায়নি।
আরও পড়ুন-
আবদুর রশিদ বলেন, ‘প্রথম দিন যখন আক্রান্ত হই, তখন সেকেন্ড অফিসার ব্রিজে ছিল। সবকিছু অনেক দ্রুত ঘটে গেছে। ৩০-৩৫ মাইল গতির বোটে এসে ওরা ব্রিজে উঠে যায়। সেকেন্ড অফিসারের দিকে তাক করে চারটা একে-ফোরটি সেভেন, আমার দিকে দুইটা। উঠেই আমাকে ও সেকেন্ড অফিসারকে আটক করে। পরে বাকি সবাইকে একই জাগায় এনে পুরো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয়।’
‘আমি বললাম, আমি রোজা, আমি বাংলাদেশি মুসলিম। নাবিকরা কান্না করছিল। জীবনে প্রথম, ভয় ছিল। কিন্তু বডি ল্যাংগুয়েজে সেটা প্রকাশ করিনি। একটা অফিসারের যেন ক্ষতি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখি,’— বলছিলেন ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ।
নাবিকদের পক্ষে দেশে ফেরার অনুভূতি জানিয়ে আবদুর রশিদ বলেন, ‘আমরা আজ মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেছি। এ অনুভূতি জানানোর ভাষা নেই। মহান রাব্বুল আলামিনের কৃপায় স্বল্প সময়ে মুক্ত হয়েছি। বহির্বিশ্বের সঙ্গে ও বৈদেশিক নৌবাহিনীর সঙ্গে সরকার যোগাযোগ রাখছিল। আমিও তাদের বলেছি, যেন কোনো অভিযান না চালায়। নৌ পরিবহণমন্ত্রীসহ সবাইকে ধন্যবাদ। সবাই সুস্থ অবস্থায় এসেছেন। এটা ভাষায় প্রকাশ করার নয়।’
এ সময় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল, জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠান কবির স্টিল রি-রোলিং মিলসের (কেএসআরএম) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম ছিলেন।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি গত ১২ মার্চ বেলা ১২টার দিকে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। ওই জাহাজের ২৩ নাবিককে জিম্মি করা হয়। জাহাজটি কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরের দিকে যাচ্ছিল।
মুক্তিপণ পরিশোধের পর গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় রাত ৩টা ৮ মিনিটে জিম্মি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ থেকে নেমে যায় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এর পরপরই জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরের পথে রওনা দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুটি যুদ্ধজাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রিত উপকূল থেকে সোমালিয়ার সীমানা পার করে দেয়।
জাহাজটি ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৪টায় আল হামরিয়া বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে। পরদিন সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় নোঙর করে জেটিতে। সেখানে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা খালাসের পর ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় সেটি চুনাপাথর বোঝাই করার জন্য মিনা সাকার বন্দরে যায়। চুনাপাথর বোঝাই শেষে আরব আমিরাতের ফুজাইরা বন্দর থেকে জ্বালানি নিয়ে ৩০ এপ্রিল দেশের পথে পাড়ি দিতে শুরু করে এমভি আব্দুল্লাহ।
জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তির একমাস পর সোমবার (১৩ মে) দুপুরে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় কক্সবাজারে পৌঁছে জাহাজটি। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ সেটা কুতুবদিয়ায় পৌঁছে নোঙর ফেলে। জাহাজটিতে নতুন নাবিক পাঠানো হয়। লাইটারেজ জাহাজে চড়ে নতুন নাবিকদের একটি দল জাহাজটির দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর মঙ্গলবার সকাল ১১টায় চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেন ওই ২৩ নাবিক।
নাবিকরা চট্টগ্রামে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে ৬৪ দিনের শ্বাসরুদ্ধকর সময়ের অবসান হয়েছে। নাবিকদের পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফুটেছে।
আরও পড়ুন-
সারাবাংলা/আইসি/টিআর