তথ্যপ্রযক্তি ডেস্ক
নিজেদের মধ্যে ভার্চুয়াল যোগাযোগ সহজ করতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী তৈরি করেছিলেন একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। ওই বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, আশপাশের ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা লুফে নেয় সেই প্ল্যাটফর্ম। সেখানে নিজেদের মতো করে প্রোফাইল তৈরি করা, বন্ধুদের মধ্যে মেসেজ চালাচালি, ছবি শেয়ার করার মতো সুবিধার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই সেই প্ল্যাটফর্ম জনপ্রিয়তা পায় যুক্তরাষ্ট্র ছাড়িয়ে বাইরের দেশগুলোতেও।
হার্ভার্ডের এক ছাত্রাবাসে সেখানকার শিক্ষার্থী মার্ক জাকারবার্গের হাত ধরে তৈরি হওয়া সেই অনলাইন প্ল্যাটফর্মটি ২০ বছর পূর্ণ করে ২১ বছরে পদার্পণ করল আজ রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি)। এই ২০ বছরে গোটা দুনিয়ারই এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে সেই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। ‘দ্য ফেসবুক’ নামে যাত্রা শুরু করা ‘ফেসবুক’ এখন কেবল নিছক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয়, প্রতিনিয়ত বিবর্তন আর নানা ধরনের সেবায় সমৃদ্ধ হতে হতে নিজেই প্রযুক্তিবিশ্বের অন্যতম শীর্ষ জায়ান্টে পরিণত হয়েছে। ফেসবুক নিজেই পরিণত হয়েছে এক ভার্চুয়াল জগতে।
ফেসবুকের যাত্রা শুরুর দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন হার্ভার্ডের ছাত্রাবাসে নিজের কক্ষ থেকে ‘দ্য ফেসবুকে’র উদ্বোধন করেন মার্ক জাকারবার্গ। এর লোগোতে ছিল অস্কারজয়ী অভিনেতা আল পাচিনোর ছবি। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের যে উদ্দেশ্যে জাকারবার্গ ফেসবুক তৈরি করেছিলেন, সে উদ্দেশ্য সফল হয় দ্রুতই। কলেজ ক্যাম্পাস পেরিয়ে অন্যদের মধ্যেও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে।
কলেজ ক্যাম্পাসের সীমানা ছাড়িয়ে প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনও হয়েছে ফেসবুকের। প্ল্যাটফর্মটি সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত হয় ২০০৬ সালে। তবে বাংলাদেশে দাফতরিকভাবে ফেসবুক চালু হয় ২০০৮ সালের ১০ জানুয়ারি। এর মাধ্যমে অনলাইন ব্যবহারের অভিজ্ঞতাই পালটে যায় ব্যবহারকারীদের। বছরের পর বছর ধরে ফেসবুক নিউজ ফিড, ছবি, ভিডিও শেয়ারিং, মেসেঞ্জার ও আইকনিক ‘লাইক’ বাটনের মতো বৈশিষ্ট্যগুলোতে ব্যবহারকারীরা যেন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দুনিয়াজুড়ে লাখ লাখ ব্যবহারকারী এখন ফেসবুক ছাড়া একটা দিন কল্পনাও করতে পারেন না।
হার্ভার্ডের এই কক্ষে বসেই প্রথমবারের মতো ফেসবুক চালু করেছিলেন মার্ক জাকারবার্গ
বিশ্বব্যাপী ফেসবুকের প্রভাব এখন আর দশটা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক বিষয়ের মতোই বাস্তব ও স্বাভাবিক। কিন্তু ২০ বছর আগে হয়তো কেউ জানত না, মাত্র চার বছরের মাথায় ফেসবুক কী করতে যাচ্ছে। ২০১০ সালের দিকে শুরু হওয়া আরব বসন্তে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক গতিপথ পালটে যায়। আরব বসন্ত নামক বিপ্লবে রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন হয়েছে, প্রাণ ঝরেছে হাজার হাজার। এই বিপ্লবী স্ফূলিঙ্গকে দাবানলে পরিণত করেছে ফেসবুকই।
বর্তমানে সামাজিক, রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক— এমন কোনো বিষয় নেই যেখানে যেখানে ফেসবুক ব্রাত্য। বরং চাইলেও ফেসবুককে দূরে রাখা যাচ্ছে না। ফেসবুকের জন্য সব দুয়ার খোলা। কারণ ফেসবুক নিজেই এক সমান্তরাল জগৎ। তাকে রুখে সাধ্য কার?
ফেসবুকের উত্থান ছিল আগ্রাসী। ফলে সাফল্যের উপজাত হিসেবে এসেছে বিতর্কও। গোপনীয়তার উদ্বেগ, জাল খবরের বিস্তার, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্লাটফর্মটির অপব্যবহারের মতো মারাত্মক বিতর্ক ফেসবুক নামটির সঙ্গে মিশে গেছে। ফেসবুক মানেই যেন বিতর্ক, উদ্বেগ, সমালোচনা।
দুই দশকের যাত্রাজুড়ে ফেসবুক উদ্ভাবনী ক্ষেত্রে নৈপুণ্য দেখিয়েছে। ২০১২ সালে ইনস্টাগ্রাম ও ২০১৪ সালে হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণের ফলে ফেসবুকের পরিসর ও ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপকভাবে। ২০২১ সালে ফেসবুকের করপোরেট নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মেটা, যার অধীনে চলে যায় খোদ ফেসবুকও। অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম, যেমন— ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো অ্যাপগুলোও চলে যায় মেটা নামক কোম্পানির অধীনে। মূলত এর মাধ্যমে একগুচ্ছ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে মহা পরাক্রমশীল হয়ে ওঠে ফেসবুক বা মেটা।
তবে ফেসবুক যতই মহীরুহ হয়ে উঠুক, এর ভবিষ্যৎ এখন সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে। সেই সঙ্গে অবশ্য অবারিত সুযোগের হাতছানিও আছে। অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থান, ব্যবহারকারীর রুচির পরিবর্তন ও অনলাইন নৈতিকতা সম্পর্কে চলমান বিতর্ক ফেসবুকের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করবে। সংস্থাটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও অগমেন্টেড রিয়েলিটির মতো উদীয়মান প্রযুক্তিগুলোতে বিনিয়োগ করছে— যার লক্ষ্য অনলাইনে সামাজিক মিথস্ক্রিয়াকে আরও বাস্তবিকভাবে অনুভব করা।
সারাবাংলা/আইই