স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
চট্টগ্রাম ব্যুরো: নির্বাচনি সমঝোতায় কপাল পুড়ল চট্টগ্রামের দুই আওয়ামী লীগ নেতা এম এ সালাম ও নোমান আল মাহমুদের। নৌকা পেয়েও জাতীয় পার্টির জন্য তাদের ভোটের মাঠ থেকে সরে যেতে হলো।
এম এ সালাম চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী ও মহানগরীর একাংশ) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। আসনটি আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির প্রার্থী আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে ছেড়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদের আসন চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী ও নগরীর একাংশ)। বর্তমান সংসদ সদস্য নোমানকে ‘বসিয়ে দিয়ে’ আওয়ামী লীগ আসনটি ছেড়ে দিয়েছে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সোলায়মান আলম শেঠকে।
আরও পড়ুন- নৌকা না পেয়ে হতাশ ২ ভাণ্ডারি
২০০৮ ও ২০১৪ সালে দুই বার আওয়ামী লীগ থেকে মনোনোয়ন পেয়েও সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে পারেননি চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ সালাম। দুবারই দলীয় সিদ্ধান্তে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে ছাড় দিয়ে ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে তাকে। এবার তৃতীয় দফায় মনোনয়ন পেলেও দলের সিদ্ধান্তে রোববার (১৭ ডিসেম্বর) প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন সালাম।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে হাটহাজারী আসন আবারও ছেড়ে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। ৪৮ বছর ধরে আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া, এতে দলটির কর্মীরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন বলে মনে করছেন নেতারা।
১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহসভাপতি এম আবদুল ওয়াহাব মিয়া। এরপর থেকে হাটহাজারীতে আর জয়ের মুখ দেখেনি দলটি। আওয়ামী লীগ থেকে ১৯৭৯ সালে জামাল উদ্দিন, ১৯৮৬-৯০ সালে নাজিম উদ্দিন, ১৯৯৬ সালে বর্তমান উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম, ২০০১ সালে ইবরাহিম হোসেন বাবুল নির্বাচন করেন।
আরও পড়ুন- চট্টগ্রামে দিলীপ বড়ুয়া, সৈয়দ ইবরাহিমের প্রার্থিতা প্রত্যাহার
২০০৮ সালে মহাজোটের ব্যানারে জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বিজয়ী হন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও তিনিই নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ইউনুছ গনি চৌধুরী মনোনয়ন নিলেও পরে জোটের স্বার্থে প্রত্যাহার করে নেন।
দ্বাদশ নির্বাচনে হাটহাজারীতে জোটগত নয়, দলীয় একক প্রার্থী চেয়েছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও তৃণমূল কর্মীরা। এ নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে মিটিং-মিছিলেও সরগরম ছিল হাটহাজারী। কিন্তু আবারও জাতীয় পার্টিকে এ আসন ছেড়ে দেওয়ায় হতাশ হয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বেদারুল আলম চৌধুরী বেদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাটহাজারী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অনেক আশা নিয়ে ছিল, এবার হয়তো নেত্রী (আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা) তাদের দিকে তাকাবেন। হয়তো আওয়ামী লীগ থেকে কোনো সংসদ সদস্য তারা পাবেন। দীর্ঘ ৪৮ বছর ধরে হাটহাজারীতে আওয়ামী লীগের কোনো সংসদ সদস্য নেই। দলের নেতাকর্মীরা আমাকে কল দিয়ে বলছেন, কেন আর আওয়ামী লীগ করবে! কতটুকু দুঃখ ও কষ্ট পেলে একজন আওয়ামী লীগের কর্মী এ কথা বলতে পারে?’
আরও পড়ুন- প্রতিদ্বন্দ্বীকে খন্দকার মোশতাক বলায় ইসিতে নদভীর বিরুদ্ধে অভিযোগ
‘জাতীয় পার্টির কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি হাটহাজারীতে নেই। নির্বাচনের আগে একটি আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে নিজেদের অস্ত্বিত্ব প্রমাণ করে শুধু। নির্বাচনি সমঝোতায় বারবার আনিসুল ইসলাম এ আসনে এমপি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তার সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি জনবিচ্ছিন্ন। ঢাকায় বসে শুধু কলকাঠি নাড়ছেন। আর কিছু না। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা খুবই মর্মাহত। সহজেই কেউ এটা মানতে পারছেন না,’— বলেন বেদারুল আলম চৌধুরী।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের এই নেতা আরও বলেন, ‘সালাম সাহেব একজন ভালো মানুষ। রাজনীতে পোড় খাওয়া কর্মী যাকে বলে। তৃণমূল থেকে রাজনীতি করছেন। মানুষ তাকে চায়। তিনি জনগণের লোক। তার সঙ্গে এরকম বারবার হচ্ছে। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ থেকে আমরা নেত্রীর কাছে আবেদন জানাই, তাকে যেন ভালো জায়গায় তিনি ভাবেন।’
এ বিষয়ে জানতে এম এ সালামের মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
আরও পড়ুন- সমঝোতায় বাদ পড়লেন জাপার ‘হেভিওয়েট’ ৬ নেতা
এদিকে চট্টগ্রাম-৮ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য মঈনউদ্দীন খান বাদলের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের টিকিট পেয়ে দক্ষিণ জেলার সাবেক সভাপতি মোছলেম উদ্দিন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি মোছলেম উদ্দিনের মৃত্যুতে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে সংসদে পৌঁছান নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদ।
এবারও এ আসনে মনোনয়ন দিয়ে নৌকার বহরে যুক্ত করা হয়েছিল তাকে। মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে যাচাই-বাছাইয়েও টিকে যান। তবে সমঝোতার কারণে তাকে সরতে হলো নির্বাচন থেকে। এ আসনে জাতীয় পার্টির হয়ে লড়বেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান সোলায়মান আলম শেঠ।
জানতে চাইলে নোমান আল মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘নেত্রীর আমাকে পছন্দ ছিল, তাই তিনি আমাকে এ আসনে দল থেকে মনোনোয়ন দিয়েছিলেন। এখন দলের প্রয়োজনে ও দেশের স্বার্থে আমি আমার মনোনোয়ন প্রত্যাহার করছি। আমি দল ও নেত্রীর সিদ্ধান্ত সবসময় মেনেই কাজ করেছি। আমি দলের কর্মী। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে আমি যাব না। ২৭ এপ্রিল থেকে আমি আট মাস সংসদ সদস্য পদে আছি। আমি যতটুকু পেরেছি ততটুকু করেছি এলাকার মানুষের জন্য।’
আরও পড়ুন- ১৪ দলের শরিকদের আসন কমে ৬
চট্টগ্রামে ৯ প্রার্থীর মনোনোয়নপত্র প্রত্যাহার
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে ছয়টি আসন থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন মোট ৯ জন। রোববার (১৭ ডিসেম্বর) সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে তারা তাদের মনোনোয়ন প্রত্যাহার করে নেন।
এদিন সকালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে গিয়ে দিলীপ বড়ুয়ার পক্ষে প্রত্যাহারপত্র জমা দেন মীরসরাই উপজেলা সাম্যবাদী দলের যুগ্ম আহবায়ক রনজিৎ বড়ুয়া। তিনি সাংবাদিকদের জানান, চট্টগ্রাম-১ আসনে নৌকার প্রার্থী মাহাবুব রহমান রুহেলকে সমর্থন জানাতেই তাদের এ সিদ্ধান্ত। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও নৌকাকে জয়ী করতে কাজ করবেন তারা।
চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন ইসলামি ফ্রন্টের প্রার্থী এম এ মতিন। তার পক্ষ থেকে প্রত্যাহারপত্র জমা দেন বাংলাদেশ ইসলামি ফ্রন্টের ফটিকছড়ি উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম ভূঁইয়া। এম এ মতিন চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনেও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। এ আসনে ভোট করবেন তিনি। একই আসনে বিকল্পধারার মজহারুল হক শাহ মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন।
আরও পড়ুন- জাপাকে যে ২৬টি আসন ছাড়ল আ.লীগ [তালিকাসহ]
চট্টগ্রাম- ৫ (হাটহাজারী ও নগরীর একাংশ) আসনে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। তিনি কক্সবাজার-১ আসন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
এ ছাড়া প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) দুই প্রার্থী— চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে জসিম উদ্দিন বাবুল ও চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে মোস্তফা কামাল চৌধুরী। দুপুরে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে দলের নেতাকর্মীরা এ প্রত্যাহার পত্র জমা দেন।
চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এনামুল হক সারাবাংলা বলেন, ‘আজ রোববার সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত মনোনোয়ন প্রত্যাহারের শেষ সময় ছিল। চট্টগ্রাম জেলার ১৬ আসনে বিভিন্ন দলের মোট ৯ জন প্রার্থী তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।’
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার শেষে চট্টগ্রামের ১৬ আসনে মোট প্রার্থী থাকলেন ১১৭ জন।
সারাবাংলা/আইসি/টিআর