স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত চট্টগ্রাম নগরীর দারুল ফজল মার্কেটকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে শুধুমাত্র ভবনের একটি তলা সিলগালা করার সিদ্ধান্তে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। পুরো ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হলেও জেলা প্রশাসন কেবল ছাত্র ইউনিয়নের কার্যালয়টিকে সিলগালা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছাত্র ইউনিয়ন বলছে, এটি তাদের ৫০ বছর ধরে ব্যবহার করা কার্যালয় থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র। তবে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, পর্যায়ক্রমে পুরো ভবনটিই সিলগালা করে সব কার্যালয় উচ্ছেদ করা হবে।
বুধবার (২২ জুন) চট্টগ্রাম নগরীর জুবিলি রোডে আলোচিত দারুল ফজল মার্কেট পরিদর্শনে গিয়ে সেটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান। তিনি আগামী রোববার (২৬ জুন) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ভবনটির তৃতীয় তলা অর্থাৎ ছাত্র ইউনিয়নের কার্যালয় সিলগালা করে দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত জানান।
একই ভবনের দ্বিতীয় তলায় চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয় আছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, শ্রমিক ফেডারেশনসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যালয় এবং দোকান-গুদামসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে ওই ভবনে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, নব্বইয়ের দশকে গোলাম আজমকে প্রতিহত করার আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে এই ভবন থেকে। এ কারণে চট্টগ্রামে ভবনটি আলাদা ঐতিহ্য ও গুরুত্ব আছে।
টানা বর্ষণের মধ্যে গত শুক্রবার (১৭ জুন) বিকেলে দারুল ফজল মার্কেটের ছাদের একাংশ ধসে পড়ে। পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে নথিভুক্ত ভবনটির তত্ত্বাবধানে আছে জেলা প্রশাসন। বুধবার জেলা প্রশাসক নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ দলটির নেতা এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কয়েকজনকে নিয়ে ভবনটি পরিদর্শনে যান। তিনি বিভিন্ন সংগঠনের কার্যালয়সহ পুরো ভবন ঘুরে দেখেন।
জেলা প্রশাসকের স্টাফ অফিসার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্লাবন কুমার বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘দারুল ফজল মার্কেটে যেসব কার্যালয় ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, সবার মতামতের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসক স্যার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, পুরো ভবনটিই ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় সেটি ভেঙে ফেলা হবে। প্রাথমিকভাবে ২৬ জুন তৃতীয় তলা সিলগালা করে দেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে বাকিগুলো সিলগালা করা হবে।’
ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের অভিযোগ, জেলা প্রশাসকের পরিদর্শনের বিষয়টি ছাত্র ইউনিয়নকে অবহিত করা হয়নি। তাদের না জানিয়েই ভবনের তৃতীয় তলা অর্থাৎ কেবল ছাত্র ইউনিয়নের অফিসটি সিলগালা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে এবং প্রয়োজনীয় সময় ও লিখিত নোটিশ দিয়ে পুরো ভবনটি সিলগালা করার জন্য বৃহস্পতিবার (২৩ জুন) জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন জানিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন।
জানতে চাইলে জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এ্যানি সেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছর ধরে ছাত্র ইউনিয়নের কার্যালয় হিসেবে দারুল ফজল মার্কেটের তৃতীয় তলার কক্ষটি ব্যবহার হয়ে আসছে। হুট করে ঘোষণা দেওয়া হলো, কার্যালয়টি সিলগালা করে দেওয়া হবে। লিখিতভাবে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। এমনকি জেলা প্রশাসক যে ভবন পরিদর্শনে যাচ্ছেন, সেটাও আমাদের জানানো হয়নি। পত্রিকায় জেলা প্রশাসনের পাঠানো বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমরা বিষয়টি জানতে পেরেছি।’
‘আমরা এই পদক্ষেপকে ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র বলে মনে করছি। না হলে পুরো ভবনই যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে আওয়ামী লীগের অফিসসহ অন্যান্য কার্যালয় বাদ বিয়ে কেবল ছাত্র ইউনিয়নের কার্যালয়কে টার্গেট করা হলো কেন? আমাদের মনে হচ্ছে, ক্ষমতাসীন চক্র জেলা প্রশাসনের ঘাড়ে বন্দুক রেখে ছাত্র ইউনিয়নকে দারুল ফজল মার্কেট থেকে সরানোর চক্রান্ত বাস্তবায়ন করছে,’— বলেন এ্যানি সেন।
জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ইমরান চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ৪-৫ বছর ধরে আমাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। কখনো আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের অফিস সহকারী, কখনো ছাত্রলীগ কিংবা হকার্স লীগের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে আমাদের অফিস ছেড়ে দেওয়ার জন্য হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্নভাবে আমাদের নেতাকর্মীদের উত্ত্যক্ত করা হয়। কিন্তু আমরা হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এভাবে আমাদের উৎখাত করতে না পেরে এখন জেলা প্রশাসনকে ব্যবহার করে ছাত্র ইউনিয়নের কার্যালয় দখলের ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছি। আমরা চাই, সিলগালা করতে হলে পুরো ভবনটিই করা হোক। ভবনে ছাত্র ইউনিয়নসহ যাদের অফিস আছে, সবার মতামতের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেবে, এটাই আমরা চাই।’
ছাত্র ইউনিয়নের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্লাবন কুমার বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ অভিযোগ একেবারেই অমূলক। ভবনটি জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, এর দায়দায়িত্ব কে নেবে? এজন্য আমরা প্রথমে তৃতীয় তলাটা সিলগালা করছি। পরবর্তী সময়ে পুরো ভবনই সিলগালা করা হবে। এরপর করণীয় নির্ধারণে জেলা প্রশাসক স্যার সবাইকে নিয়ে বসবেন। সেখানে ছাত্র ইউনিয়নের কোনো বক্তব্য থাকলে তারা বলতে পারবে।’
চট্টগ্রাম মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এ ভবনটি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ভবনটি বেহাত হয়ে যায়। পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেয়। আমরা ১৯৮৫ সালে আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে একটি কক্ষ আওয়ামী লীগের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহারের জন্য দিই। কেউ কেউ চাচ্ছে, ছাত্র ইউনিয়নের অফিস এখানে না থাকুক। তবে আমরা চাই যে এই ভবনে যাদের অফিস আছে, সবাই এখানে থাকুক। ভবনটি যদি নতুন করে নির্মাণ করা হয়, সেখানে সবাই যেন আগের মতো কার্যালয় পায়, সেটা আমাদের প্রত্যাশা।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর