ধরুন আপনি একজন উদ্যোক্তা হতে চান কিংবা আপনি একজন নতুন উদ্যোক্তা কিন্তু আপনার অফিস স্পেস নেই কিংবা অফিস স্পেস কেনার পর্যাপ্ত টাকা নেই? সেক্ষেত্রে আপনি কি করবেন? অথবা ধরুন আপনি একজন ফ্রীল্যান্সার আর আপনি ঠিক যখন কাজ করতে বসছেন তখনই কেউ না কেউ এসে আপনাকে কোনো কাজ দিয়ে যাচ্ছে কিংবা ছোটরা ক্রমান্বয়ে বিরক্ত করে যাচ্ছে। ঠিক এভাবেই কাজ করার সময় নানাভাবে আপনার মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে।
কাজের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিভ্রান্তি ও সমস্যার কথা চিন্তা করে নাবিলা নওরিন ও নাহিদ শারমিন – দুই বেস্ট ফ্রেন্ড শুরু করেন একটি ভিন্ন ধর্মী উদ্যোগ “মোড়”। নাবিলা নওরিন ও নাহিদ শারমিন ব্রাক ইউনিভার্সিটি থেকে আর্কিটেকচার এর উপর পড়াশোনা করে ২০১৫ সালে দুই বন্ধু মিলে এই উদ্যোগ গ্রহণ করেন আর সেই থেকেই মোড়ের আজ অবধি পথচলা।
মোড় একটি কো ওয়ার্কিং স্পেস যেখানে অফিস বা বাণিজ্যিক যেকোনো কাজের জন্য জায়গা ভাড়া দেওয়া হয়। মোড়-এ ঘন্টা, দিন বা মাসের ভিত্তিতে ওয়াইফাই ইন্টারনেটসহ কাজ করার জায়গা অর্থাৎ টেবিল বা মিটিং রুম ভাড়া দেওয়া হয়। ফ্রিল্যান্সার, তরুণ উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে ছোট ছোট ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীদের জন্য পারফেক্ট একটি কাজের স্পেস দেয়ার প্রচেষ্টা করছে মোড়।
একজন উদ্যোক্তার দক্ষতার সাথে কাজ করে টিকে থাকার প্রয়োজনীয় সকল জিনিস নিয়ে মোড় সাজানো হয়েছে। একটি ওয়ার্ক স্পেস যেখানে প্রতিটি মানুষ যেন অত্যন্ত কার্যক্ষম ভাবে নিজেদের কাজ করতে পারবে এই লক্ষ্য নিয়ে মোড় এর পথচলার শুরু।
বর্তমানে মোড়ের তেজগাঁও, বনানী ও ধানমন্ডিতে তিনটি শাখা রয়েছে যার প্রত্যেকটি শাখায় মোড় একই সময়ে আলাদা ২৫ থেকে ৬০ জন মানুষকে ওয়ার্কিং স্পেস ও প্রায় ৮ থেকে ২০ জনকে নিভৃতে কাজের জন্য অফিস দিতে সক্ষম । আর প্রায় ৮০-১২০ জন মানুষকে নিয়ে সেমিনার এরেঞ্জ করার ক্ষমতা ও রাখে মোড়। আর কেবলমাত্র মোড় এর অফিসে ঢুকে নিজের নাম রেজিস্টার করে পছন্দ মত প্যাকেজের মূল্য পরিশোধ করেই ওয়ার্কিং স্পেস, সেমিনার কিংবা মিটিং রুমে কাজ শুরু করে দেয়া যাবে।
মোড়ের সদস্য না হলেও প্রতি ঘণ্টা ১৫০ টাকায় মোড়ের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করা যাবে এবং মাসে ২ হাজার টাকা দিয়ে হওয়া যাবে ‘স্টার্টার’ সদস্য। তখন মোড়ের তিনটি শাখার যেকোনোটিতেই মাসিক সর্বমোট ৪০ ঘণ্টা ব্যবহার করতে পারবেন উদ্যোক্তারা। আবার ৮ হাজার টাকা দিয়ে ‘ইনফিনিটি’ সদস্য হলে ইচ্ছামাফিক যত ঘণ্টা খুশি মোড়ে অফিস করা যাবে। সদস্যদের জন্য আছে খাবার এর কক্ষ ও কফির সুবিধা।
Youth School For Social Entrepreneurs (YSSE) এর একটি ইন্টারভিউতে নাবিলা বলেন, শিকাগো তে Illinois Institute Of Technology এ পড়াশোনার সময় প্রথম কো ওয়ার্কিং স্পেস সম্পর্কে ধারণা পান। তিনি সেখানে পড়াশোনা করার সময় ব্রাজিলে “millennials and their banking habits” এর উপর একটি রিসার্চ করার সময় প্রথম কোনো কো ওয়ার্কিং স্পেস এ যান। ব্রাজিলের মানুষের সাথে বাঙালীদের মিল খুঁজে পেয়ে তার মনে হয় যে, বাংলাদেশে যদি এমন কো ওয়ার্কিং স্পেস থাকতো তবে বেশ ভালো হতো।
পড়াশোনা শেষে বন্ধুরা মিলে একটা অফিস সেট আপ করতে গিয়ে এই বিষয়টি তিনি সম্পূর্ণ ভাবে উপলব্ধি করেন এবং অবশেষে তার বেস্ট ফ্রেন্ড নাহিদ শারমিনকে নিয়ে মোড় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৩ তে শুরু করতে চাইলে ও ২০১৪ এর সেপ্টেম্বরে মূলত তাদের দুজনের বিয়েতে পাওয়া গিফট এর টাকা দিয়ে মোড় নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। শুরুতে একটা প্রজেক্ট হিসেবে মোড় এর কাজ শুরু করলেও শুরুর প্রায় ৯ মাস এর মধ্যে মোড়ের রেজিষ্ট্রেশন করেন। আর এ পথচলায় পুরোটা সময় তাদের দুজনের স্বামী সবসময় তাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছেন এবং প্রতিটি প্রয়োজনে সাহায্য করে গেছেন।
তাদের Struggle এবং Ups and Downs সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোড় এর আনকমন আইডিয়া টা মানুষের কাছে পৌঁছানো টা বেশ কষ্টকর ছিল এবং মোড় শুরু করার সময় উদ্যোক্তাদের জন্য একটা স্ট্রাকচার এর অভাব ছিল তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। আর সফলতা নিয়ে জানতে চাইলে বলেন, ২০১৫ থেকে ২০২১ অবধি ৬ বছর ধরে মোড় এর টিকে থাকাটাই সবচেয়ে বড় সফলতা। তাদের বর্তমান ক্যাপাসিটি থেকে শুরু করে ২০১৯ এ ধানমন্ডি ও ২০২১ এ তেজগাঁও-এর নতুন শাখা খোলা -কে তাদের সফলতা মনে করেন।
তবে মোড় এর নতুন শাখা খোলা আর পরিচিতি লাভ হলেও এখনো বেশির ভাগ মানুষ মোড় সম্পর্কে অজ্ঞাত। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, উবার যেমন ব্যবহারকারি সহ সবার মাঝে পরিচিত তেমনি একদিন মোড় ও যেন সবার কাছে পরিচিতি পায়। তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশে যদি উদ্যোক্তাদের জন্য কোনো গাইড লাইন থাকতো আর নতুন উদ্যোক্তাদের সাথে কাজ করার মানসিকতা যদি সবার মধ্যে থাকতো তবে ওনাদের মত উদ্যোক্তাদের কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যেত।”
করোনাকালীন সময়ের পরিবর্তন নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনার চেয়ে করোনার পূর্বে অবস্থাটা বেশি ভালো ছিল এবং পরিবর্তন বলতে করোনা কালে কমার্শিয়াল এলাকার থেকে আবাসিক এলাকাতেই বেশি মানুষজনের রেসপন্স বেশি ছিল। আর করোনাকালে তাদের ক্লাইন্টদের নিরাপত্তার জন্য তারা নো মাস্ক নো এন্ট্রি সিস্টেম এবং স্যানিটাইজার এর ব্যবস্থা করেছেন। এর পাশাপাশি প্রতিটি ক্লাইন্ট চলে যাওয়ার পর তাদের ব্যবহৃত জায়গাগুলো স্যানিটাইজ করা হয়। আর যদি কেউ অসুস্থ হয় সেক্ষেত্রে বাকিদের সুবিধার জন্য অসুস্থ ক্লাইন্ট এর মেম্বারশীপ ২১ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়। সেক্ষেত্রে একজন সদস্য সুস্থ হয়ে ফিরে এসে তার ক্রয়কৃত ঘণ্টা পুনরায় ব্যবহার করতে পারেন।
ভবিষ্যতে তিনি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় মোড় এর শাখা খুলতে চান আর দেশের প্রতিটি মোড়ে মোড় থাকার স্বপ্ন দেখেন। অফিসের কাজের পাশাপাশি অন্যান্য কাজের জন্য ও স্পেস তৈরি করতে চান। তরুণ প্রজন্মের জন্য ম্যাসেজ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কখনো হতাশ হওয়া যাবে না কারণ কোনো কিছু পাওয়ার প্রবল ইচ্ছা ও প্যাশন থাকলে সফলতা আসবেই । নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে আর অন্য কেউ আপনার কাজ করে দিবে এই আইডিয়োলজী থেকে বের হতে হবে। সেই সাথে শুধু নিজের জন্য না সকলের জন্য কি ভালো হয় কিংবা কিভাবে সকলের ভালো হয় সেটা ভাবতে হবে।
মোড় এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো আপনি যদি ১% এফোর্ট দেন তাহলে তারা সেটার ১০% আপনাকে ফেরত দিবেন। নাবিলা নওরিন ও নাহিদ শারমিন তাদের এই ভিন্ন ধর্মী অসাধারণ উদ্যোগ এর জন্য রাইজিং স্টার অব দ্য ইয়ার ক্যাটাগরিতে নারীদের জন্য সিটি ব্যাংকের বিশেষায়িত সেবা সিটি আলোর সহায়তায় কালারস প্লাটিনাম বিজনেস উইমেন অ্যাওয়ার্ড-২০১৯ পেয়েছেন। মোড় এর মত উদ্যোগগুলো একসময় যখন সবার কাছে পরিচিতি ও অনুপ্রেরণা পাবে তখন তরুণরা নির্ভয়ে উদ্যোগ নিতে পারবে এবং দেশের উন্নতি সম্ভব হবে ।
You can check our other blogs here: https://ysseglobal.org/blog/
Author
Mahmuda Sultana Mim
Intern, Content Writing Department
YSSE