সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৩৫ পূর্বাহ্ন

টর্চার! শব্দটা বদলায়নি, বদলেছে শুধু ধরণ!

প্রতিবেদকের নাম
  • আপডেট সময়: মঙ্গলবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২১
  • ২১৮ সময় দেখুন
টর্চার! শব্দটা বদলায়নি, বদলেছে শুধু ধরণ!


এমি জান্নাত

এমি জান্নাত :: লেখাটা পেশাগত কারণেই একটা জরিপ থেকে কিছু বাস্তব চিত্র নিয়ে। কয়েকটি জীবন আর সময়ের সাথে মিলিয়ে সাজানো তাদের গল্প..

সাজেদা আক্তার রাজধানীর মিরপুরের একটি বস্তিতে থাকেন ছেলে, ছেলের বউ আর দুই নাতি নাতনী নিয়ে। স্বামী মারা গিয়েছেন। বউয়ের সাথে এটাসেটা নিয়ে গজগজ করতে থাকেন সারাদিন। দেখে আনুমানিক ৫০-৫৫ বছর মনে হলেও তিনি বললেন ৪০ হবে। যাই হোক, তার বিয়ে হয়েছিলো ১২-১৩ বছর বয়সে। সেই সময় আসলে বাল্যবিবাহের প্রচলন অনুযায়ী স্বামী সংসার কিছুটা বুঝে নিয়েই তারা সংসার শুরু করতো। তার শাশুড়ী তাকে দিয়ে সব কাজ বলতে শুকনো মরিচ বাটা থেকে শুরু করে গর্ভকালীন সময়ে কুয়ো থেকে পানি উঠানো, অন্যের বাড়িতে ঢেঁকি পাড় দিয়ে দুমুঠো চাল আনতে পাঠানো আর যাবতীয় কাজ করাতেন।

এমনিতেই খাবার জুটতো না আর পেটে বাচ্চা থাকলে তো খেতেই নেই! খাবার দিয়ে পাকস্থলী ভরা থাকলে বাচ্চা বড় হওয়ার জায়গা পাবে না যে! আর স্বামী তো গ্রামের গৃহস্থের বাড়িতে দিনমজুর খেটে রাতের আয়েশ মিটিয়ে খালাস। ভোর থেকে আবার থেকে একই চিত্র। সেই সুবাদে ৫ ছেলেমেয়ে সহ ৪ জন মৃত সন্তানের জন্ম দিয়ে শরীর ভেঙে ৩৫ পার হতেই অজানা অসুখে স্বামী মারা গেলেন। বসতভিটা বলতে একটা ছোট ছনের (এক প্রকার শুকনো বড় ঘাস) বাড়ি। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে দুইজন গার্মেন্টস এ চলে আসলো, দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে আর এক ছেলে আর বউয়ের সাথে ঢাকায় আসলো জীবিকার তাগিদে।

কারণ ওই দুই ছেলে টাকা পয়সা দেয়না আর মেয়েদের সংসারেও টানাটানি। এই একটা ছেলেই মাকে কাছে রাখলো। এই ছেলেও একটা দোকানে কর্মচারীর চাকরি পেলো আর শাশুড়ী বউ দুজনে কয়েকটি বাসায় কাজ নিলো। যদিও ছেলে চাকরি ছেড়ে নেশায় মন দিয়েছে কিছুদিন পরেই!

এবার আসি ছেলের বউ রেহানার কাছে। ৩ বছরের মেয়ে আর দেড় বছরের ছেলে নিয়ে সারাদিন দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এত ছোট বাচ্চা রেখে কাজে যেতে পারেনা তাই সারাদিন শাশুড়ী খাওয়ার খোটা দেয়। কারণ শাশুড়ী এখনো কাজ করে। তার টাকায় বসে বসে কেন খাবে! তাই সমস্ত কাজের ভার বউয়ের। রাতে নেতিয়ে পরা শরীরে মাতাল স্বামীর মার খেয়ে তার চাহিদা মিটিয়ে কিছু বাকি থাকেনা জীবনের।

কিছুদিন পর হয়তো বাচ্চা দুটোকে রাস্তায় রেখে বাচ্চাদের দুমুঠো ভাত আর মাতাল স্বামীর নেশার টাকা জোগাতে আবার বাড়ি বাড়ি কাজ করবে রেহানা। মার খেয়ে, খোটা শুনে, চোখের পানি শুকিয়ে এটাই তার কাছে স্বাভাবিক জীবন মনে হতে বাধ্য করা হয়েছে। আতিয়া বেগমকে তার ছেলের কর্মকান্ডের কথা বললে তার যুক্তি হলো “পুরুষ মানুষই তো এইরামই হইবো। আমরা কত অইত্যাচার মাতায় নিয়া কাম করছি! আমরা ভালা মানুষ বইলা সুখে আছে বউ।” হায়রে সুখ!

শায়লা বেগম একটি সরকারি হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র নার্স। স্বামী অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। একটাই মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন বড় ঘরে। আর একমাত্র ছেলে রাসেল সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আর উচ্চশিক্ষিত ছেলের বউ একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক।

এবার কথা হয় শুধু ছেলের বউ ইভার সাথে। গল্পের মাঝে বলছিলেন বিয়ের দুই বছর পর অনেক যুদ্ধ করে চাকরিতে যোগ দিয়েছি। প্রেমের বিয়ে, শুরুতে চাকরি করতে দিবে বলে বিয়ের পর ঘটলো বিপত্তি! সংসার কে সামলাবে! হাজবেন্ড রাসেলকে বললে সে বললো মা-বাবা চান না, ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কী! আর চাকরির দরকার তো নেই। একটা বাচ্চা হোক, তুমি ওকে নিয়ে সময় কাটাবে। আমাদের যথেষ্ট আছে, তোমার যা দরকার চেয়ে নিবে! এই চেয়ে নেওয়ার ব্যাপারটাই মনকে কিছুতেই বোঝাতে পারছিলো না ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স করা ইভা।

এদিকে দুটো কাজের মেয়ে দুইবেলা এসে সব কাজ করতো। ইভার বিয়ের পরই একজনকে বাদ দেওয়া হয়। রান্নাবান্নাসহ ঘরের কাজ তো বউই করবে! বাকি ঘরমোছা আর ভারী কাপড় ধোয়ার কাজ শুধু একটা বুয়া করবে। পারলে সেটাও ছাড়ানো হতো, নেহাতই ইভা প্রতিবাদ করে বলেছিলো এগুলো সে পারবে না। সেই নিয়ে ননদ শাশুড়ীর কটুক্তির শেষ নেই! জমিদারের মেয়ে তো নয়, নাকি! অনেকটা মানিয়ে নিয়ে, মেনে নিয়ে নয় কিন্তু! বিয়ের ছয় মাসের মাথায় কনসিভ করে ইভা। বাচ্চা পেটে আসলে অসুস্থ হবে, খুবই স্বাভাবিক। রাসেল একটু যত্ন নিলে সেটা সবার চোখে আদিখ্যেতা! আর তাই কম খোঁচা শুনতে হয়নি ইভাকে। মাঝে মধ্যে ছেলের বউয়ের পক্ষ নিলে সে আরেক বিপত্তি! তাই শ্বশুর অবশ্য এখানে নিরব ভূমিকাই পালন করতেন।

তিনমাস অনেক কষ্ট সহ্য করে আরেক যুদ্ধ জয় করে বাবার বাড়ি যেতে পারলো। এখানে বাবার বাড়ি যেতে পারাটাই যুদ্ধ জয়ের চেয়ে কম কিছু নয়! সন্তান হবার পর শ্বশুরবাড়ি আসতেই সংসার আর বাচ্চা সামলে দিনের পর দিন হতাশায় জীবনকে অর্থহীন মনে হতে লাগলো। রাত জেগে বাচ্চা আর দিন জেগে বাচ্চা সংসার আর পান থেকে চুন খসলে শ্বাশুড়ি মার অগ্নিদৃষ্টিতে ভেঙেচুরে যেতে থাকে ইভার মন। রাশেদ সব দেখেও দেখেনা।

মাঝে মাঝে ওকেও অসহায় মনে হয় ইভার! ছয় মাস কোনো রকমে কাটিয়ে তারপর চাকরির সিদ্ধান্ত নেয় ইভা। কিন্তু বাচ্চা কে সামলাবে! ইভা বলেই ফেলে আপনারা তো আছেনই আর আমি একটা মেয়ে রেখে দিবো। শুধু একটু চোখের দেখাটা দেখবেন। এতে আরেক যুদ্ধ শুরু হলো। পাষাণ মা, বেয়াদব নানান তকমা গায়ে লাগিয়ে রাশেদ আর পরিবারের সাথে বিশাল যুদ্ধ আর মনোমালিন্য করে চাকরিতে যোগদান করে ইভা।

এখানেই শেষ নয়, স্কুল যাওয়ার আগে এবং পরে ঘরের ফেলে রাখা ইভার জন্য বরাদ্দ কিছু কাজ করতেই হবে! চাকরি করতে পারছে এইটুকু স্বান্তনা নিয়ে তবুও সবটা সামলায় ইভা। আর অশান্তি বাড়াতে ইচ্ছে করেনা! এখন প্রশ্ন শায়লা আক্তার নিজে চাকরি করেছেন তাহলে বউকে কেন করতে দেবেন না! উত্তরটা ইভাই দেয়।

কারণ শাশুড়ী নাকি অনেক যুদ্ধ জয় করে চাকরি করেছেন, তো তিনি চাননা ছেলের বউ সেই যুদ্ধ জয় করে একই অশান্তি বাড়াক! কিন্তু কী অদ্ভুত না! যে জিনিসগুলো তাদের সাথে ঘটেছে সেগুলোর পুনরাবৃত্তি তারা না ঘটালেই কিন্তু অশান্তি শব্দটার জায়গা হয়না। কিন্তু এটা অনেকটা মনের অজান্তেই প্রতিশোধস্পৃহা থেকে চক্রের মতো ঘোরে।

এখানে সবারই ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে। আদিকাল থেকেই এভাবে স্ট্যাটাস অনুযায়ী শারিরীক এবং মানসিক টর্চারের ধরণটা বদলায় শুধু। দুটো গল্পে অতি নিম্নবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের চিত্র ঘুরে ফিরে এক। আরও উচ্চবিত্তের ক্ষেত্রে হয়তো বিষয়গুলোর লেভেল অন্যরকম। কিন্তু দিনশেষে এরকম হাজারো রেহানা, ইভার কান্নার স্বর একই থেকে যায়!

.

Print Friendly, PDF & Email



Source link

অনুগ্রহ করে এই পোস্টটি আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর