ভালো থাকার প্রথম শর্ত হল সুস্বাস্থ্য। সুস্বাস্থ্যকে আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারি, দেহের সার্বিক সুস্থতা এবং স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা বজায় রাখার মাধ্যমে। আর সুস্বাস্থ্য কিংবা সুস্থ থাকার প্রথম শর্তই হল একটি আদর্শ ওজন। শরীরের ওজন যখন অস্বাভাবিক অথবা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখনি শুরু হয় নানা ধরণের শারীরিক সমস্যা।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে অতিরিক্ত বা অনিয়ন্ত্রিত ওজন বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার একটি অন্যতম কারণ। তাই সুস্থ থাকার জন্য ওজন কমানো এবং নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে খুব সাধারণ কিছু বিষয় মাথায় রেখে ওজন নিয়ন্ত্রণ করলে আপনি সুস্থতার সাথে, কোনো ধরণের দৈহিক সমস্যা ছাড়াই কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যে আপনার কাম্য ওজন অর্জনে সক্ষম হতে পারবেন।
তবে অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বপ্রথম আপনাকে জানতে হবে আপনার ওজন বাড়ার কারণ। অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য যেমন প্রথমে রোগ নির্ণয়ের প্রয়োজন হয় ঠিক তেমনি অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্যও ওজন বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানাটা খুব জরুরি। ওজন বৃদ্ধির পেছনে বিভিন্ন ধরনের কারণ থাকতে পারে। যেমন- বিভিন্ন শারীরিক অবস্থাভেদে ওজন বাড়তে পারে। বিভিন্ন অসুস্থতার কারণেও ওজন বাড়তে পারে যেমন- পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম কিংবা হাইপোথাইরয়েডিজমের মত হরমোনাল ডিজঅর্ডারের কারণে আকস্মিক ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে। তাছাড়াও মানসিক বিষণ্ণতা বা অবসাদ, ঔষধের প্রভাব, পুষ্টির সঠিক শোষণ ব্যাহত হওয়া, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন পদ্ধতি ইত্যাদি কারণেও ওজন বাড়তে পারে। তবে ওজন বাড়ার সবচেয়ে বড় ও সার্বজনীন একটি কারণ হল, অনিয়ন্ত্রিত বা অনুপযুক্ত খাদ্যাভ্যাস। অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ, খাদ্য গ্রহণের সঠিক নিয়ম না জানা, খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের ভ্রান্ত ধারণা, সঠিক সময় অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ না করা ইত্যাদি এ সমস্ত সাধারণ কারণগুলো দেহের ওজন বাড়ার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রথমেই আপনাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে এবং সেই সাথে একটি লক্ষ্য স্থির করতে হবে। কেননা যেকোনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করাটা একান্ত প্রয়োজন। আপনাকে মনে মনে নির্ধারণ করতে হবে যে কতটুকু ওজন আপনি কমাতে চান। মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার পর যে কাজটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল, নিজের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের ধরণ সম্পর্কে মনযোগী হওয়া। একটি সঠিক ও যথাযথ খাদ্যাভ্যাস তৈরি করা ছাড়া কখনই আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সবার আগে যে জিনিসটির প্রতি নজর দিতে হবে তা হল সুষম খাদ্য বা ব্যালেন্সড ডায়েট। সুস্থ স্বাভাবিক দেহ ও আদর্শ ওজন রক্ষার জন্য প্রতিদিনের কিংবা প্রতিবেলার খাদ্যতালিকায় সুষম খাদ্যের বিকল্প নেই। এখন কথা হল, সুষম খাদ্য বলতে আমরা কি বুঝি? সেটিই হল সুষম খাদ্য যাতে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি পুষ্টি উপাদান সঠিক অনুপাতে বিদ্যমান থাকে। অর্থাৎ, কার্বোহাইড্রেট প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিনস ও মিনারেলস, এই সব কয়টি পুষ্টি উপাদানের সমন্বয় সমৃদ্ধ খাদ্যই হল সুষম খাদ্য। প্রতিবেলার খাবারে এই প্রত্যেকটি পুষ্টি উপাদান যেন উপস্থিত থাকে এবং খাবার থেকে এর কোনোটি যেন বাদ না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আবার কোনো একটি উপাদানকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো উপাদানযুক্ত খাদ্য অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে যা ওজন কমানোর স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি নয়।
ইদানিংকালে আমাদের মধ্যে অনেকেই অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন ডায়েটচার্ট অনুসরণ করে ওজন কমানোর চেষ্টা করে থাকেন। আবার অনেকে নিজেই নিজের ডায়েটচার্ট বানিয়ে নেন যা তার নিজের ওজন, উচ্চতা বা শরীর স্বাস্থ্যের সাথে একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। এতে শরীরের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং নানা ধরণের শারীরিক সমস্যা দেখা যায়।
অনলাইনের তথাকথিত এইসমস্ত ডায়েটচার্টের বেশির ভাগই তৈরি হয়ে থাকে অনভিজ্ঞ কিছু লোকজনদের দ্বারা যা শুধু মানুষ আকর্ষণের জন্য তৈরি করা হয়ে থাকে। ফলস্বরূপ এসমস্ত অনুপযোগী ডায়েটচার্ট অনুসরণ করার ফলে দেহে নানা ধরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ওজন কমানোর ক্ষেত্রে অনেকেই বিশাল বড় একটি ভুল পন্থা অবলম্বন করে থাকেন যেটি হল খাদ্য তালিকা থেকে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা একেবারেই বাদ দিয়ে দেন। এটি কখনই ঠিক নয় কারণ আমাদের শরীরের শক্তির প্রধান উৎসই হল শর্করা। এছাড়াও দেহের সার্বিক কার্যক্রম ঠিক রাখার জন্য মস্তিষ্কে যে অক্সিজেন এর প্রয়োজন হয় তা শর্করা বা গ্লুকোজ রক্তের মাধ্যমে ব্রেনে সরবরাহ করে থাকে। হ্যাঁ, ওজন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শারীরিক অবস্থাভেদে শর্করা জাতীয় খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে তাই বলে একেবারে বাদ দিয়ে দিলে তা শরীরের মুখ অঙ্গগুলোর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে।
আবার ওজন কমানোর ক্ষেত্রে অনেকেই অনেক বেশি পরিমাণে প্রোটিন জাতীয় খাবার গ্রহণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হওয়ার মাধ্যমে কিডনির ক্ষতি হতে পারে। তাই প্রোটিন ও শারীরিক অবস্থা ও চাহিদা অনুযায়ী গ্রহণ করতে হবে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ফ্যাট বা চর্বি গ্রহণ কমিয়ে আনতে হবে তবে একেবারেই বাদ দেওয়া ঠিক নয়। এক্ষেত্রে উদ্ভিজ্জ তেলই হতে পারে শরীরের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ফ্যাট। ফ্যাট যেহেতু একটি মুখ্য পুষ্টি উপাদান যা শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের ‘ফ্যাট সলিউবল ভিটামিন’ এর শোষণে সাহায্য করে ও শক্তি উৎপাদন করে থাকে তাই খাদ্য তালিকা থেকে তেলকে একেবারে বাদ দেওয়া স্বাস্থ্যকর নয়।
ওজন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে, ভিটামিন ও মিনারেলসের কোনো জুড়ি নেই। ফল, শাক, সবজি ইত্যাদি হল ভিটামিন ও মিনারেলস এবং সেই সাথে হাই ফাইবারের (খাদ্য আঁশ) সর্বোৎকৃষ্ট উৎস। ফল ও প্রচুর পরিমাণে শাক-সবজি গ্রহণ করলে সুন্দর একটি ওজন নিয়ন্ত্রিত হয়। কারণ ফল, শাক-সবজিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা খাদ্যআঁশ থাকার কারণে খাবারগুলো খুব সহজেই ক্ষুধা নিবারণ করে ও অনেক সময় পর্যন্ত পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে খাদ্য গ্রহণের ধরণ, পরিমাণ ও সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খাবারকে ছোট ছোট মিলে ভাগ করে অল্প অল্প করে কিছুক্ষণ পর পর খাওয়াটাই সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। একসাথে অনেক খাবার খেয়ে নিলে দেহের প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত পরিমাণ খাবার য়রীরে শরীরে ফ্যাট হিসাবে জমা হয়ে যায়। ফলস্বরূপ ওজন বৃদ্ধি পায়। আবার ইচ্ছেমতো, অনিয়ম করে না খেয়ে বরং প্রতিদিন প্রতিবেলার খাবার একটি নির্দিষ্ট সময়ে ও একবেলার খাবার থেকে আরেকবেলার খাবারের সময়ের একটি নির্দিষ্ট ব্যাবধান বজায় রেখে খাবার গ্রহণ, ওজন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ওজন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে খাবারের পাশাপাশি কিছু শারীরিক ব্যায়াম করাটা খুবই জরুরি। শরীরকে স্বুস্থ, কর্মক্ষম রাখতে প্রতিদিন শারীরিক ব্যায়ামের বিকল্প নেই। ব্যায়াম মানেই যে আপনাকে জিমে যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য সবচেয়ে ভালো স্বাস্থ্যসম্মত ব্যায়াম হল হাঁটা। প্রতিদিন নিয়মিত হাঁটুন। যতটুকু সম্ভব হাঁটার চেষ্টা করুন।
দৈনিক কমপক্ষে আধা ঘণ্টা হলেও হাঁটুন। সুযোগ থাকলে দৌড়াতেও পারেন। এছাড়াও সম্ভব হলে প্রতিদিন কিছু সময় সাইকেলিং করুন অথবা সাঁতার কাটুন। এতে আপনার শরীর থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্যালরি ঝরে যাবে যা শরীরে ফ্যাট হিসাবে জমা হওয়ার কারণে ওজন বৃদ্ধিকে ব্যাহত করবে। তাছাড়াও ঘরে আপনার শরীরকে সক্রিয় রাখার চেষ্টা করুন। সারাক্ষণ শুয়ে বসে না থেকে শরীরকে কর্মক্ষম রাখুন। এতে যেমন ওজন নিয়ন্ত্রণ হবে তেমনি শরীরের সার্বিক সুস্থতাও রক্ষা হবে এবং পাশাপাশি মনও প্রফুল্ল থাকবে।
অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি কিংবা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জীবন যাপনের পদ্ধতি একটি বড় ফ্যাক্টর। অস্বাস্থ্যকর উপায়ে জীবনযাপন করার কারণে যেমন ওজন বৃদ্ধি পায় তেমনি নানা রকম স্বাস্থ্য জটিলতাও দেখা দেয়। তাই নিয়ন্ত্রিত একটি পদ্ধতিতে জীবনযাপনের চেষ্টা করুন। যেমন-সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক সময়ে ও পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম ও দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক কাজকর্ম সম্পাদন করার চেষ্টা করুন। যখনি আপনি একটি স্বাস্থ্যসম্মত জীবন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাবেন তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
অতিরিক্ত ওজন একটিমাত্র শারীরিক অবস্থা হলেও সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি। তাই বয়স বাড়ার সাথে সাথে বর্ধিত ওজনকে যদি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তাহলে নানা ধরণের শারীরিক জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে পারবেন খুব সহজেই। তবে এই ওজন নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি হতে হবে অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত। আার স্বাস্থ্যসম্মত ও কার্যকর উপায়ে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পরামর্শ নিতে পারেন একজন বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদের। কখনই না জেনে, না বুঝে অনুপযোগী উপায়ে ওজন কমাতে গিয়ে নিজের শরীর স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলা উচিৎ নয়। তাই সুস্থ থাকতে হলে যথাযথ ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন ও প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন। স্বাস্থ্যই যেহেতু সকল সুখের মূল তাই সুন্দর একটি ওজন বজায় রাখার মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য রক্ষা করুন এবং ভালো থাকুন।
লেখক: শিক্ষার্থী, খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান, হোম ইকোনমিক্স ইউনিট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
The post ওজন নিয়ন্ত্রণ করবেন যেভাবে appeared first on Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment.