সবার মতো আমারও একটা বাবা আছে। কিন্তু অন্যদের মতো আবেগ-অনুভূতি মিশিয়ে কখনো তাকে নিয়ে কিছু লেখা হয় না । যদিও আমার জীবনে তার অবদান লিখে শেষ করা যাবে না তবুও একটু লিখছি । আমাদের প্রচলিত গ্রামের বাসায় ছোট থেকে আব্বা ডাকা হতো। আব্বা আমার জীবনের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তিনি অনেক শক্ত হাতে শাসন করতেন আমাকে। অনেক সময় মনে হতো তিনি আমার শত্রু। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে আমার ধারণা গুলো ভুল প্রমাণিত হতে শুরু করল। আর কাল আবর্তনে আব্বার শাসন গুলোও হারিয়ে গেল। এখন শুধু তিনি নামাজের জন্য তাগাদা দেন বাকি বিষয়গুলো আমার উপরেই ছেড়ে দেন।
আব্বা কে নিয়ে একটি ছোট্ট ঘটনা শেয়ার করছি। যদিও হুবহু লিখতে পারবো না তবুও লিখছি। আমার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। আমার সমবয়সী জেঠাতো ভাই আছে তার নাম ফাহিম। সমবয়সী হওয়ার কারণে নাম ধরেই ডাকা হতো একে অপরকে। কদিন ধরেই আমাদের দুইজনকে স্কুলে ভর্তি করা নিয়ে গুঞ্জন শুনা যাচ্ছিল। স্কুলটা ছিল আমাদের পাশের এলাকায় শরিফুল স্যারের কেজি স্কুল। পরদিন সকাল বেলা মেঘযুক্ত আকাশ। পূব দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে । এমন ঠান্ডার মাঝেই আম্মা ভোরবেলা আমাকে গোসল করিয়ে দিল। ওই দিক দিয়ে ফাহিম কেউ গোসল করিয়ে নতুন জামা কাপড় পড়ানো হচ্ছে। তাদের আয়োজন দেখে আমি মনে মনে অনেক ভয় পাচ্ছিলাম। স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারটা অন্যদের কাছে কেমন লাগতো আমি জানিনা তবে আমার কাছে খুবই ভয় লাগতো । আম্মাকে জিজ্ঞেস করে বসলাম আমারে কই নিয়ে যাওয়া হবো । আম্মা বলল তগরে স্কুলে ভর্তি কারবার নিয়ে যাবে তর বাপে।একসময় আমি আর ফাহিম বুদ্ধি করলাম আমরা কিছুতেই আজকে স্কুলে ভর্তি হতে যাবো না। কি করা যায় চিন্তা ভাবনা শুরু করলাম। স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। কোন উপায় না পেয়ে নতুন কাপড় চোপড় পরিধান করেই আমাদের ঘরে খাটের তলায় লুকিয়ে পড়লাম। আমরা দেখতে পাচ্ছি সবাই মিলে সারা বাড়ি তছনছ করে খুঁজছেন। কোথাও আমাদের খুঁজে পাচ্ছে না। এক সময় তারা অনেক চিন্তায় পড়ে গেলেন । অনেকে ভাবতেছে যে পুকুরে পড়েছে কিনা। আমাদের ভয় বাড়তে থাকে এই ভেবে যে এখন বের হলো আব্বা নাজানি কি করবে আমাকে। কিছুক্ষণ পর আমরা স্বেচ্ছায় বের হয়ে আসি। সবাই অনেক বকাঝকা করল। আমাদের পড়ালেখা করার ইচ্ছা নেই। এমনও বলা হলো দুইটা গরু কেনা হবে আমরা দুইজনে ঘাস খাওয়াবো। সামান্য বিষয়ে আব্বা যে কড়া শাসন করেন আজকে ভাবছিলাম আমাদের নিস্তার রাখবেন না।
কিন্তু আব্বা সেদিন কিছু বললেন না। আমি একটুখানি বিস্মিতই হয়েছিলাম। যাই হোক তিনি সেদিন রাতের মাঝেই তার বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে নিজেই একটি কেজি স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নেন। এমনকি যথারীতি সেটি কাজে বাস্তবায়ন করেন। স্কুলে গিয়ে আব্বাকে স্যার ডাকবো না আব্বা ডাকবো সেটা নিয়ে আবার বাকবিতণ্ডা বেজে যেত মনের ভিতর।তখন বুঝি নাই যে শুধু আমাদের ওইদিনের ঘটনার জন্য স্কুল টা খোলা হয়েছিল। এখন বুঝি ব্যাপার গুলো।অভাব, অভিযোগ বা অনুযোগ— অনেক কথাই তাকে বলা হয়। কিন্তু আরও কথা থেকে যায়। যা বলব বলব করে কখনোই বলা হয়ে ওঠে না। কিছুটা অভিমানে, মধ্যবিত্তের সংকোচে, বাকিটা গোপনে—সেই কথাগুলো থেকে যায় নিজের ভেতরে! ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় বলা হয়ে ওঠে না আব্বার প্রতি ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা কিংবা মুগ্ধতার কথা। দূর থেকে তোমাকে অনেক অনূভব করি আব্বা। হয়তো তোমার প্রার্থনার কারণেই আমার কখনো কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। তোমার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি আব্বা। যেন শেষ সময়টা আরেকটু মসৃণ দেখে যেতে পারো।
লিখেছেন,
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোঃ মুন্তাসির মাহমুদ।