সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ,
যে শিক্ষকের লেখা পড়ে আমরা শিক্ষিত হচ্ছি, আজ তাদের নিয়ে কলম ধরতে আমরা বাধ্য হলাম। যে শিক্ষকের লেকচারে আমাদের বিবেকের দুয়ার খুলেছে ,আজ সেই বিবেকের তাড়নায় আমাদের লিখতে হচ্ছে।
একেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চার দেওয়ালে ঘেরা ফুলের বাগান। আমাদের সেই চারদেয়াল হল আপনারা শিক্ষকরা। কিন্তু সেই দেয়াল ভেদ করে হানা দিয়েছে হায়নার দল। সেই বাগান থেকে এক একটা ফুল তুলে নেওয়া হচ্ছে, এক একটা ফুলকে ক্ষত-বিক্ষত করা হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে।
আসলে আমরা ভুল বলেছি আপনাদের শিক্ষকদের দেয়াল ভেদ করে নয়, আপনারা নিজেরাই শত্রুদের প্রবেশ পথ দিয়েছেন।
আপনারা থাকতে আমাদের উপর সশস্র হামলা করে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করা হলো! মেধাবীরা যদি এভাবে গুলিতে শহিদ হয়ে যায়, তাহলে এসব মেধাবীদের গড়ে তুলে কী লাভ হলো? শুধু শুধু পুলিশের গুলির সামনে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়ার জন্য! পুলিশ ও ডিবি মধ্যরাতে হানা দিয়ে হাজার হাজার নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের পরিবারের কাছ থেকে তুলে নির্যাতন করছে।
আপনারা কীভাবে এই শহীদ শিক্ষার্থীদের রোল কল করবেন?! আপনারা কি তাদের শূণ্যতা অনুভব করবেন না?! আমরা কীভাবে সেই ক্লাসে বসবো, যেখানে আমাদের পাশের সিটের সহপাঠী নেই?! কেমন লাগবে যখন আপনাদের শিক্ষার্থীরা ক্রাচ-এ ভর করে, আঘাতপ্রাপ্ত চোখে কালো চশমা পরে ক্লাসে আসবে?! যারা হাতে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে, তারা কি আগের মতো কলম ধরতে পারবে?!
শিক্ষকদের শক্ত প্রাচীর যদি আমাদের ঘেরাও করে রাখত, তাহলে এত শিক্ষার্থীর লাশ কখনোই পড়তো না। আমাদের এই সোনার বাংলা আজ লাল রক্তে ছেয়ে যেত না।
কোন ভবনের ক্ষতি হলে যেমন করে রাজমিস্ত্রিরা ঠিক করে তেমন করে শিক্ষার্থীদের মিস্ত্রি আপনারা শিক্ষকরা। দেখুন না আপনারা! আমাদের কত নিষ্পাপ প্রাণ ঝরে গেল, আমাদের কত স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে গেল। আমাদের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখুন – আমরা আজ ক্ষত-বিক্ষত, রক্তে রঞ্জিত। স্বৈরাচারের বন্দুকের নিশান আজ আমাদের বুকে। কারাগারে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, রিমান্ডের নির্যাতনে আজ মেধাবীদের ঠিকানা হচ্ছে। এটাই কি তবে আধুনিক শিক্ষা?! এটা কি তবে সভ্যতা?!
মা-বাবার পরেই আমরা শিক্ষকদের স্থান দিয়েছি। আমাদের দুর্দিনে আমাদের মা-বাবা চিৎকার করে কাঁদতে পারলে, আপনারা কি আমাদের পাশে একটু দাঁড়াতে পারেন না? আমাদের ব্যথায় ব্যথিত হতে পারেন না? আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থী কত ক্লাস করলাম, একসাথে কত অনুষ্ঠান করলাম, ছবির ফ্রেমে শিক্ষক শিক্ষার্থী কতবার বন্দি হয়েছি। সব কি মিথ্যা ছিল?
ফেসবুকে আপনাদের নাম উল্লেখ করার আগে ‘প্রিয়’ শব্দটা জুড়ে দিতাম। প্রিয় অমুক স্যার, প্রিয় অমুক ম্যাডাম। আমাদের সেই শ্রদ্ধা, ভক্তিকে আপনারা এইভাবে তুচ্ছ করলেন? এই খারাপ সময়ে আপনারা কেন নীরব দর্শক হয়ে আছেন?! আপনারা কি আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছেন যে খারাপ সময় ছেড়ে যেতে হয়?! তাহলে আমরা কি এতদিন ভুল মানুষদেরকে শিক্ষাগুরু মেনে এসেছি?!
শুনেন, আমাদের থেকে দূরে চলে যাওয়া শিক্ষকরা – আমাদের যদি জীবন বোধ না শিখাতে পারেন, যদি সৎসাহসী, দেশপ্রেমিক হতে না শেখান, তাহলে আমাদের এই পুঁথিগত শিক্ষা লাগবে না। যে বিদ্যা জাতির ক্রান্তিলগ্নে খসে পড়ে, জাতিকে পথ দেখাতে পারেনা, আমরা সেই বিদ্যাকে নর্দমায় ছুড়ে মারলাম।
আপনারা না জাতির কারিগর?! তাহলে জাতির জন্য কি তৈরি করছেন? এ জাতির সর্বাঙ্গে যে পঁচন ধরেছে তার চিকিৎসা কোথায়? তার চিকিৎসক কে? এই উত্তর কি আপনাদের থেকে আমরা পেতে পারি না?
কাজী নজরুল ইসলাম যেমনটা বলে গেছেন
“এদেশের নাড়ীতে-নাড়ীতে, অস্থিমজ্জায় যে পঁচন ধরেছে তাতে এর একেবারে ধ্বংস না হলে নতুন জাত গড়ে উঠবে না।”
এই জাতি ইতিমধ্যেই ভঙ্গুর হয়ে গেছে। তাহলে আর কত ভঙ্গুরতার জন্য অপেক্ষা করবেন? আর কত ভাঙলে আপনারা কথা বলবেন? আর কত পঁচন ধরলে আপনাদের বিবেক নাড়া দিবে?
পতাকার লাল অংশ আজ বৃহৎ সবুজ অংশকে খেয়ে ফেলেছে। আমাদের রক্তে সবুজ বাংলা আজ রক্তিম আভায় চেয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ মানুষ মারা গেল। আরও কয়েকশো শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। এই কয়েকদিনে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত হয়রানি করা হচ্ছে। আর আপনারা আমাদের অভিভাবক হয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন? কেন? চাকরি বাঁচানোর জন্য? আপনাদের কাছে আমাদের রক্তের চেয়ে চাকরিটা বড় হয়ে গেল, তাই না? আজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণে ধ্বংসের প্রান্তে। এটার জন্য কি আপনারা দায় এড়াতে পারবেন? আপনাদেরকে মনে করিয়ে দিতে চাই আর্চবিশপ ডেসমন্ট টুটুর বিখ্যাত উক্তিটি-
“জুলুমের কালে তুমি যদি নিরপেক্ষ থাকো তাহলে তুমি সেই জালিমের পক্ষই নিয়েছো”।
তাহলে কি আমরা আপনাদেরকে তাই ভাববো? সেটা কি আমাদের সমীচীন হবে?প্রিয় শিক্ষকবৃন্দ – জাতির মেরুদন্ডে আঘাত এসেছে। এ সময় ছাত্রসমাজ জাতি পুনর্গঠনে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। আজ ছাত্রসময়ের সমাজের পাশে আপনাদেরকে ভীষণ প্রয়োজন। সব চাপ উপেক্ষা করে, সকল বাঁধা পেরিয়ে আমাদের সাথে আসুন। আমাদের আন্দোলনকে সফল করুন।
শ্রেণী কক্ষে যেমন আমাদের শিক্ষা দিতেন, গাইডলাইন দিতেন, উপদেশ দিতেন। তেমনি ভাবেই এই আন্দোলনে আমাদের সমর্থন করুন। আমাদের অনুপ্রেরণা দিন। প্রয়োজন হলে আপনারা পদত্যাগ করুন।তারপরেও এই অন্যায়ের সাথে আপোষ করবেন না।
আমরা দেখবো, আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দের উপস্থিতিতে আমাদের বুকে গুলি চালায় কিভাবে। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দের উপস্থিতিতে আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে ট্রিগারে চাপ দেওয়ার সাহস আছে কার। আপনারা আমাদের সাথে উপস্থিত হলে আমাদের আন্দোলন সফল হবেই। আপনারা একেকজন শামসুজ্জোহা হোন।
ইতি-
আপনাদের স্নেহের সাহসী শিক্ষার্থীরা
-বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন