রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ দশমিক ৪৯ শতাংশ নারী, আর ৪৯ দশমিক ৫১ শতাংশ পুরুষ। তবে জনসংখ্যার এই অনুপাতের দেখা মেলে না সরকারি চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণে। জেন্ডার গ্যাপ কমানোর উদ্দেশ্যে সরকারি চাকরিতে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা বহাল ছিল।
তবে ২০১৮ সালে ৪০তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হয়। এ সময় নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। পরে ২০২১ সালে সেই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রিট করেন। ৫ জুন এই রিটের রায়ে পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে আবার আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’–এর ব্যানারে ১ জুলাই থেকে টানা আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় গত রোববার (২১ জুলাই) সামগ্রিকভাবে বাতিল (রদ ও রহিত) করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। পাশাপাশি মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ অন্যদের জন্য বাকি ৭ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে। রায়ে অবশ্য আদালত বলেছেন, এই নির্দেশনা ও আদেশ সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজনে ও সার্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।
সোমবার (২২ জুলাই) রাতে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ অন্যদের জন্য বাকি ৭ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন অনুমোদন করেছে সরকার। এতে সরকারি চাকরির ১ থেকে ২০তম গ্রেডে নারীদের জন্য কোনো কোটা সংরক্ষিত থাকছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনই নারী কোটা বাতিলের মতো পর্যায়ে পৌঁছেনি বাংলাদেশ। জনসংখ্যার অনুপাতে কর্মক্ষেত্র, সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া ও নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ এখনও সীমিত।
নারীর ক্ষমতায়ন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসহ নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে ও তাদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন ইতিবাচক পদক্ষেপ। এমনই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ বা (Affirmative Action) হলো কোটা ব্যবস্থা। কিন্তু এখন সরকারি চাকরির সকল গ্রেডে নারীর জন্য কোটা না থাকায় বৈষম্য বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশিষ্টজনেরা। তবে উন্মুক্ত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নারীরা যোগ্যতা প্রমাণ করেই এগিয়ে আসবেন বলে আশা প্রকাশ করছেন কেউ কেউ। এক্ষেত্রে জেন্ডার নির্বিশেষে শুধুমাত্র যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ করতে পিএসসিসহ নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে নারীদের জন্য সংরক্ষিত কোটা বাতিল হওয়ায় নারীর প্রতি বৈষম্য বাড়বে। কোটা সংস্কারে সরকারি চাকরিতে বৈষম্য নিরূপণের যে দাবি ছিল, এই প্রজ্ঞাপন সেই দাবির সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোটা ব্যবস্থা রাখা হয়। নারীর জন্য সংরক্ষিত কোটা বাতিলের বিষয়টি হতাশাজনক। এতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, সংসদে নারীর জন্য নির্দিষ্ট আসন সংরক্ষণ, স্থানীয় সরকারে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে সরকারের নেওয়া নানা কার্যক্রমকে পিছিয়ে নেবে। এর প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতেও।’
ছাত্রদের আরও গভীরভাবে চিন্তা করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রীর বক্তব্য পুরো দেশের নারীর বৈষম্যকে রিপ্রেজেন্ট করে না। খোদ বিশ্ববিদ্যালয়েও নানারকম বৈষম্য বিদ্যমান। সেটি নিয়েও কথা বলতে হবে।’ সারা বিশ্বেই নারী অন্যায্যতার শিকার। খোদ আমেরিকাও সেটি শিকার করে। তাই ন্যায্যতার জন্য কোটা। কোটা মেধার বিকল্প না। নারীরা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পায় না দেখেই কোটা রেখে তাদের এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেন মহিলা পরিষদ সভাপতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ রকম সহিংস হয়ে ওঠার আগেও আমি বলেছি ও লিখেছি যে, দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হলেও সরকারি চাকরিতে সেটির সমান প্রতিনিধিত্ব নেই। যেহেতু বাংলাদেশের অনেক জেলা আছে যেখানে নারীরা পিছিয়ে থাকেন নানা কারণে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানা কারণে তারা নারীর পথে নানারকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। তাই নারী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জন্য আলাদা করে কোটা রাখা হয়। আর এটি রাখা খুবই জরুরি। কারণ, আমাদের সংবিধানেই বলা হয়েছে, আমাদের দেশের অনগ্রসর মানুষদের ব্যপারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। এ ছাড়া যেকোনো বিবেচক মানুষই এটি শিকার করবেন, সমাজে নারীরা নানাভাবে নানারকম প্রতিবন্ধকতার শিকার হন এবং তাদের পক্ষে সমান সুযোগ পাওয়া সম্ভব হয় না।’
তিনি বলেন, ‘সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণিকে দিয়ে বিচার করলে হবে না। অল্পকিছু নারীর ক্ষমতায়ন হলেও দেশের এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে নারীরা সমান সুযোগ পান না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক নারী শিক্ষার্থী নিজেদের ক্ষমতায়িত ভাবছে। আর নিজেদের এই অবস্থান দিয়ে পুরো বাংলাদেশকে বিচার করা এক ধরণের ফ্যালাসি। একইসঙ্গে আদালতের পর্যবেক্ষণকে প্রজ্ঞাপন হিসেবে জারি করাও একধরণের হঠকারী সিদ্ধান্ত। এটিতে চিন্তিত হওয়ার অনেক জায়গা রয়েছে। এর ফলে দেশের একটি বড় অংশের জনগণ যাদের Affirmative Action দরকার, তাদের আমরা বঞ্চিত করতে যাচ্ছি। সেক্ষেত্রে সরকারি চাকরিতে অর্ধেক নারী থাকবেন, এই জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে গেল। সুতরাং, আমাদের চিন্তত হওয়ার প্রয়োজন আছে এবং আমি মনে করি সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনারও প্রয়োজন আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, এই তাড়াহুড়োর প্রয়োজন ছিল না। ২০১৮ সালেই একটি কমিশন গঠন করে জনসংখ্যার অনুপাতে কোটা নির্ধারণ করা যেত। কোটার যে সংস্কার হলো সেটি নিয়ে গর্বিত হওয়ার জায়গা থেকে অনেক দূরে আছি আমরা। অবশ্যই আমি মনে করি, নারীদের কোটা থাকার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জেলার নারীদের। পিছিয়ে পড়া জেলার শুধু নারীরাই নয়, পুরুষরাও বৈষম্যের শিকার। তাই আমাদের হুট করে নয়, চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন ছিল।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রীরাও নারী কোটা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ছয় বছর আগেও দেখেছি এবং এখনও দেখছি শিক্ষার্থীরা একটি দাবি করলেও সেটি নিয়ে কথা বলার পর তারা রিভাইস করেছে। আন্দোলনকারীদের দিক থেকে প্রাথমিক বিবেচনায় নারী কোটা বাতিলের দাবি ভুল ছিল। কিন্তু পরে তারা রিভাইসও করেছে। তাদের বক্তব্য শুনেও মনে হলো যে, তারা ওই পাঁচ শতাংশের মধ্যেই সব কোটা রাখা যেত এমনটা ভাবছে। তবে অনগ্রসর হিসেবে সংবিধান যাদের চিহ্নিত করছে, আমরা তাদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি। অবস্থা আসলে ছয় বছর আগে যেখানে ছিল, সেখানেই থেকে গেল। আমার মনে হয়, ছাত্ররা দাবি করতেই পারে। কিন্তু সরকারের আরও বেশি বিচক্ষণতা দেখানোর প্রয়োজন ছিল। সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর হিসেবে চিহ্নিত একটি বড় গ্রুপকে বাদ রাখা হলো।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোটা উঠিয়ে নেওয়ায় সরকারি চাকরিতে নারীদের সংখ্যা কমে গেছে। আবেদনকারীই কমে গেছে। আন্দোলনে আগামী পাঁচ বছর অন্তত কোটা রাখার দাবি করা যেত। তবে এখন যেহেতু কোটা উঠিয়েই দেওয়া হলো, আমাদের দেখতে হবে আগামীতে এর কী প্রভাব পড়ে। আগামী এক বছর পর ফলাফল অ্যানালাইসিস প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘মেয়েরাও দেখছি কোটা উঠিয়ে নেওয়ার দাবি করেছে। বয়স কম, অভিজ্ঞতা কম- তাই তারা হয়তো একই কাতারে দাঁড়িয়ে দাবি জানাচ্ছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, এটিই তাদের চাহিদা। সারাজীবন মেয়েরা কোটার ওপর নির্ভরশীল থাকবে, তা তো নয়। ওরা যদি সাত পাঁচ না ভেবে এক কাতারে দাঁড়ায় সেটা তাদের চাহিদা। তাই আগামীর জন্য তাদের প্রস্তুত হতে হবে। সেইসঙ্গে বাকি সবাইকেও প্রস্তুত হতে হবে। রিক্রুটমেন্টের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বোঝাপড়াটা করতে হবে। সবাইকে এক কাতারে বিবেচনা করতে হবে।’
সারাবাংলা/আরএফ/রমু