স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: হাওরের প্রতিবেশ বিধ্বংসী যত স্থাপনা সেগুলো সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সিলেট অঞ্চলে ঘন-ঘন বন্যার কারণ, পুনর্বাসন ও স্থায়ী সমাধান বিষয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এই আহ্বান জানান।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, যেগুলো পরিবেশ আইনের আগেই হয়ে গেছে সেগুলো আবার রিভিউ করে প্রয়োজনে ‘আনডু’ করে দেন। ‘সিলেট অঞ্চলে ঘন ঘন বন্যা: কারণ, পুনর্বাসন ও স্থায়ী সমাধান’ শীর্ষক ওই গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা সিলেটের সাম্প্রতিক বন্যার মত এমন প্লাবন রোধে হাওর অঞ্চলে পরিকল্পিত উন্নয়নের আহ্বান জানিয়েছেন।
সোমবার (৪ জুলাই) বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সিলেট বিভাগ সাংবাদিক সমিতি (সিবিসাস), ঢাকার আয়োজনে এবং অল ইউরোপিয়ান বাংলা প্রেসক্লাবের সহযোগিতায় আয়োজিত ওই গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তারা বন্যা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় জনগণ ও গবেষকদের মতামতে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান তুলে ধরেন।
গোলটেবিল আলোচনায় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, হাওর অঞ্চলের উন্নয়নে সিলেট এলাকার ভূতাত্ত্বিক গঠনকে মাথায় রাখতে হবে যেহেতু এর গঠন কিছুটা আলাদা। মেঘালয়ের বৃষ্টি হলে সেটি দ্রুতগতিতে সিলেটে আসবে এটিই স্বাভাবিক। তাই যদি জোর করে এখানে রাস্তা বা অন্যান্য স্থাপনা বানানোর চেষ্টা করা হয়, সিলেটে বন্যা হওয়াই স্বাভাবিক। হাওর অঞ্চলে রাস্তা যদি এলজিআরডি বানায় তাহলে সেখানে কাজ করবে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার যে শুধু জানে এক গ্রামের সঙ্গে আরেক গ্রামের সংযোগ স্থাপন। এখানে ওয়াটার রিসোর্সের কেউ না থাকায় কোনো নদীতে কতটুকু পানি বা কোথায় কতটুকু প্রবাহ তা বিবেচনায় না এনেই রাস্তা বানিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই ১২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা আমরাই বানিয়েছি। আবার তিনদিনে এত বৃষ্টিপাত কখনও হয়নি। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন ঘটনা আর অস্বাভাবিক নয়। তাই পরিকল্পনার সময় আমাদের অবশ্যই নদ-নদী-হাওরের ভূ-পকৃতির গঠনকে মাথায় রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন নদীর মুখ আটকে কোন স্থাপনা নয়। সেভাবেই আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে।
গোলটেবিল বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মতিন উদ্দীন আহমেদ বলেন, চেরাপুঞ্জিতে একশ বছরের জুন মাসের দৈনিক গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৭৭২ ঘনমিটার। আর এবছরের জুন মাসে হয়েছে ৫ হাজার ৩৪৩ মিলিলিটার। একশ বছরের গড় ১১ হাজার ৫৫০ মিলিলিটার। আর এবছরের জুন পর্যন্ত এখন ইতোমধ্যে ১০ হাজার ২২৪ মিলিলিটার বৃষ্টি হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব ঘটনাকে বলা হয়েছে এক্সট্রিম ইভেন্ট এবং এমন এক্সট্রিম ইভেন্ট বাড়তে থাকবে। এমন এক্সট্রিম ইভেন্টের জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। যেকোন পরিকল্পনার সময় এমন এক্সট্রিম ইভেন্টের দশ বছর রিটার্ন পিরিয়ড বা একশ বছর রিটার্ন পিরিয়ডের কথা বিবেচনা করা হয় কিন্তু এখন এক্সট্রিম ইভেন্ট এমন কোন সাইকেল মেনে আসে না, যেকোন সময়ে এমনটা হতে পারে। পরিকল্পনার সময় এগুলো আমাদের মাথায় রাখতে হবে। এটি বিশেষ ধরণের ভূ-তাত্ত্বিক এলাকা। সিলেট এলাকার ভূ-প্রকৃতি, ভূ-তাত্ত্বিক গঠন, হাইড্রলজি, পাথরের গঠন সবই বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে আলাদা। বৃষ্টির পানি তিন ভাগ হয়। একভাগ মাটির উপরিভাগ বা চ্যানেল দিয়ে আসে, একভাগ বাষ্পীভূত হয় এবং আরেক ভাগ মাটির নিচ দিয়ে যায়। সিলেট এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক গঠনের জন্য এখানে মাটির মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বেশি পানি প্রবাহিত হয়। এর সঙ্গে প্রচুর পলি আসে যা হাওরে জমা হয় যার ফলে হাওরের নিচের ভাগ উঁচু হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে উপরিভাগে আমরা মাটির বিভিন্ন ব্যবহার করছি যার ফলে বিপর্যয় বাড়ছে।
এর সঙ্গে সীমান্তের ওপাশে অর্থাৎ মেঘালয় এবং শিলংয়ে কি ঘটছে তার প্রতিফলনও সিলেট এলাকার ভূ-প্রকৃতিতে প্রভাব ফেলছে। তাই পরিকল্পনার সময় আমাদের এসব সঠিক তথ্য-উপাত্ত মাথায় রাখতে হবে। এখন আমরা বন্যা নিয়ে কথা বলছি। মাস দুই পরে বলব ক্ষরা নিয়ে। পানি যেমন সম্পদ তেমনি দুর্যোগেও রূপান্তরিত হচ্ছে, তাই আমাদের একসঙ্গে দুর্যোগ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা করতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়নের জন্য স্থানীয় গবেষকদের যুক্ত করতে হবে। বিদেশি গবেষকদের এনে পরিকল্পনা করলে সেটি ফলপ্রসূ হবে না। পানি ব্যবস্থাপনার জন্য নদীর জন্য জায়গা ছাড়তে হবে। দুই পাড়ে বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বদলানো যাবে না। নদীর দুই তীরে স্থাপনা না করে নদীর গতিপথ ঠিক রাখতে জায়গা রাখতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, সিলেটের বন্যায় দেখলাম সরকার যাওয়ার আগে মানুষ চলে গেছে। দেশের সব প্রান্ত থেকে সাহায্য এসেছে। এই বন্যায় গত ৩০-৩৫ বছরের সব অবকাঠামো শেষ। এমন কোনো সড়ক নেই যা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। গ্রামের ছোটখাটো সড়ক নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হাওড়ের মানুষকে সুন্দর জীবনযাপন দেওয়ার পাশাপাশি দুর্যোগ প্রতিরোধও সম্ভব। প্লাবন হতেই পারে কিন্তু তার জন্য হাওড় এলাকার সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। হাওড় এলাকার মানুষ পানির মধ্যে থাকবে এটা হতে পারে না। প্রথমে ত্রাণ, তারপর নির্মাণ। বন্যাদুর্গত এলাকায় মানুষ এখন টাকা চাচ্ছে খাদ্য সহায়তা না। অনেকেরই ঘর কাঁচা যাদের ঘর একদম নষ্ট হয়ে গেছে। ৯০ শতাংশ ঘরে এখন টিন আছে। আমারা চেষ্টা করছি ঘরের মেঝে পাকা করা হোক ও আরসিসি পিলার দিয়ে বানানো হোক। এতে তাদের ঘর নষ্ট হয়ে যাবে না। আমাদের সরকার গত কয়েক বছর যে স্কুল বিল্ডিং বানিয়েছে সেগুলো এখন কাজে লাগছে। সেসব বিল্ডিংয়ে হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে। তারা নানা টেবিল করে করে আমাকে দুর্বল আর গরিব চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। বিশ্বে আমরা সবার সঙ্গে থাকবো। কিন্তু শেষ কাজটা আমাদের নিজেদেরই করতে হবে।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ বলেন, এমন প্লাবন প্রতিবছর আসবে এমন চিন্তা করা যাবে না। দ্রুত কর্মপরিকল্পনা আনতে হবে। যে কোন কাজের জন্য সরকারের দিকে তাকানো একমাত্র সমাধান না। নিজেদেরও কিছু কিছু করতে হবে। পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার সমন্বয় প্রয়োজন। হাওর এলাকায় ঘরগুলোর ডিজাইন আলাদা করতে হবে। খাসিয়ারা যেমন মাচায় থাকে তেমন প্রকৃতি বান্ধব পরিকল্পনা করতে হবে।
বিশেষ অতিথি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী শাহাব উদ্দীন আহমেদ বলেন, বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। আমি নিজেও চিন্তা করতে পারিনি যে দুইদিনের বৃষ্টিতে এমন বন্যা হবে। গাছপালা নেই তা আমিও স্বীকার করি। ছোটবেলায় আমার বাড়ির পাশে বাঘ শিকার হতে দেখেছি। সেখানে এখন ইউএনও অফিস। পাহাড় এখন ১৫ কিমি দূরে চলে গেছে। খালের রেকর্ডও নাই অনেক জায়গায়।
বন্যা প্রতিরোধে দেশের খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওর, বিলসহ অন্যান্য জলাশয় খননে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে জানিয়ে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, জলাশয়গুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে পারলে বন্যার তীব্রতা কমানো সম্ভব হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কমাতে পরিবেশ সংরক্ষণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে ও অবাধে বৃক্ষ নিধন, পাহাড়, টিলা কর্তন বন্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী সুরমা ও কুশিয়ারার নদীপথ পুনরায় চালু করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, সরকারের বিশেষ উদ্যোগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যে কোনো দুর্যোগে অসহায় মানুষের সহযোগিতায় সমাজের সামর্থ্যবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান মন্ত্রী ।
ত্রাণ কার্যক্রম সম্পর্কে জানাতে প্রতিদিনের বাংলাদেশের সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি বলেন, ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে যেয়ে দেখেছি প্রত্যন্ত এবং তৃণমূল পর্যায়ে ত্রাণ দেওয়ার উপায় ছিল না পর্যাপ্ত নৌকা না থাকায়। আবার ভাড়াও ছিল অত্যন্ত বেশি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধের পরিকল্পনা পর্যাপ্ত না। সরকারিভাবে কিছু নৌকা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে যেন বন্যা হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছানো যায়। এখন আর ত্রাণ নয়, পুনর্বাসন করতে হবে।
পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম বলেন, আমাদের ২৫টি আন্তঃসীমান্ত নদীর তথ্য শুধু রয়েছে। আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলেছি, আমাদের ৫৪টি নদীর তথ্যই লাগবে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান রয়েছে সিলেটে। সিলেটে ১২০ কোটি ৮১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, সুনামগঞ্জে ১৯১ কোটি ৬৩ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা, মৌলভীবাজারে ৯৯৬ কোটি টাকা, হবিগঞ্জে ৫৭৩ কোটি টাকার প্রকল্প চলমান রয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্যানেল বিশেষজ্ঞ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এম ফিরোজ আহমেদ বলেন, আমরা অজান্তে আমাদের বিল এরিয়া বা যেগুলোকে জলাশয় বলি, সেগুলোকে ভরাট করে আমরা কৃষিজমি করে ফেলছি। আমরা মনে করি, কৃষিজমি হলে ব্যক্তি পর্যায়ে লাভজনক হওয়া যায়। কিন্তু আমরা জানি না, জলাভূমির আউটপুট কোনো অংশে কম না। হাওর এলাকার যেসব রাস্তা পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে, সেগুলো সংকুচিত করে প্রয়োজনে ব্রিজগুলো ওপেন করে দিতে হবে।
সিলেট অঞ্চলে বারবার বন্যা রোধে করণীয় সম্পর্কে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, স্থায়ী সমাধান দেশিয় পর্যায়ে সম্ভব না। এর সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয় জড়িত তাই সমাধানের ক্ষেত্রেও এই দুই বিষয়ের সমন্বয় প্রয়োজন যা নিয়ে কার্যক্রম পর্যাপ্ত না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সীমান্তের ওপারে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ যেন একে লস অ্যান্ড ড্যামেজ হিসেবে উপস্থাপন করে। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ ঘটাচ্ছে উন্নত বিশ্ব কিন্তু ভুক্তোভোগী আমাদের মত দেশগুলো। এই বিষয়টিই বাংলাদেশকে তুলে ধরতে হবে নিজেদের পক্ষে যাতে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যে দরকষাকষি হচ্ছে সেখানে আমরা যেন লাভবান হতে পারি। আবার মেঘালয়ের বন কাটা, মাইনিংকে যতটা দোষারোপ করা হচ্ছে দেশের গাছ কাটা নিয়ে সেরকম কোন পরিকল্পনা নেই। বিশ্বব্যাপী বন উজাড়ের হার এক দশমিক তিন, বাংলাদেশে যেটি দুই দশমিক ছয়। বন রক্ষার জন্য একুশটা জেলায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কমিটি থাকলেও তারা বন নিধন থামাতে পারছে না। বন বিভাগ বাড়ির আশপাশের গাছপালাকেও বন হিসেবে দেখিয়ে বনের গড় অনেক বেশি দেখায়।
এদিকে নদী কমিশন বানানো হয়েছে কিন্তু তারা নদী নিয়ে কাজ করছে না। নদী রক্ষায় কমিশন নয়, দরকার আইন। হাওর উন্নয়ন বোর্ড আছে দেশে কিন্তু এতবড় বন্যা নিয়ে তাদের কোন বক্তব্য শুনলাম না। এরকম কমিশন দিয়ে কাজ না হলে দরকার হলে কমিশন ভেঙে দিন। হাওরের উন্নয়ন পরিকল্পনায় স্থানীয় মানুষের বক্তব্য শুনতে হবে। এছাড়া আমাদের একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিনের ব্যবহার বন্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।
সারাবাংলা/আরএফ/একেএম